বাংলাদেশ

তিন শতাধিক বিচারককে জেলা জজ পদে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত

Advertisement

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বড় ধরনের রদবদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত — সুপ্রিম কোর্ট। অধস্তন আদালতের তিন শতাধিক বিচারককে জেলা ও দায়রা জজ পদে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভা।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর ২০২৫) বিকেলে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফুলকোর্ট সভায় দেশের সব বিচারপতিরা অংশ নেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে সর্বসম্মতভাবে এই পদোন্নতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বিচার বিভাগের ইতিহাসে অন্যতম বড় পদোন্নতি

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবারের পদোন্নতি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ রদবদল। এত বিপুল সংখ্যক বিচারককে একসঙ্গে জেলা জজ পদে উন্নীত করা এই প্রথম। এর ফলে সারাদেশের বিচার প্রশাসনে এক নতুন নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি হবে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলায় জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচার বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। নতুন পদোন্নতিপ্রাপ্ত বিচারকদের মাধ্যমে জেলা আদালতের কর্মপরিবেশে নতুন প্রাণ ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ফুলকোর্ট সভায় কী আলোচনা হয়েছে

ফুলকোর্ট সভার একজন অংশগ্রহণকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অধস্তন আদালতের কর্মকর্তাদের দক্ষতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এ বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেন এবং বিভিন্ন বিভাগের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতির অনুমোদন দেন।

সভায় বিচারকদের পদোন্নতির পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পদায়ন ও স্থানান্তর নীতিমালা নিয়েও আলোচনা হয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ

পদোন্নতির সিদ্ধান্ত এখন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এরপর পদোন্নতিপ্রাপ্ত বিচারকদের দায়িত্ব বণ্টন করা হবে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে।

আইন মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আমরা দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেশের বিভিন্ন জেলায় যেসব জেলা জজের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে, সেখানে দ্রুত নতুন পদায়ন করা হবে।”

কেন এত বড় পদোন্নতি প্রয়োজন হলো

গত কয়েক বছরে বহু জেলা জজ অবসর গ্রহণ করেছেন, কেউ কেউ উচ্চ আদালতে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর ফলে অধস্তন আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বের ঘাটতি তৈরি হয়।
বিশেষ করে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, অর্থঋণ আদালত এবং জেনারেল রেকর্ড আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ আদালতগুলোতে অনেক দিন ধরে পদ শূন্য ছিল।

এই ঘাটতি পূরণ করতেই নতুন পদোন্নতির উদ্যোগ নেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, নতুন জেলা জজদের মাধ্যমে মামলার জট নিরসনে গতি আসবে।

বিচার বিভাগের রূপান্তর ও প্রত্যাশা

আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মীরা এই সিদ্ধান্তকে বিচার বিভাগের পুনর্গঠনের বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ বলেন,

“বাংলাদেশের বিচার বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকটে ভুগছিল। এত বড় সংখ্যক পদোন্নতি বিচার বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

তিনি আরও বলেন, “যদি এই বিচারকরা যোগ্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলে জনগণের বিচারপ্রাপ্তির অধিকার আরও সুদৃঢ় হবে।”

বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি

নতুন জেলা জজদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে জুডিশিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (JATI) বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে। প্রশিক্ষণে বিচার ব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার আইন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বিষয়ে কোর্স অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

একজন কর্মকর্তা জানান,

“বর্তমান বিশ্বে বিচার ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নতুন জেলা জজদের ডিজিটাল কোর্ট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।”

বিচার প্রশাসনে নতুন দিগন্ত

দেশের বিচার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে মামলার জটে জর্জরিত। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিম্ন আদালতে প্রায় ৪৫ লাখ মামলা বিচারাধীন ছিল।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন জেলা জজদের মাধ্যমে এই জট কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর নির্বাহী পরিচালক জানান,

“বিচারকদের সঠিক বণ্টন ও দক্ষ প্রশাসনই বিচার বিভাগের প্রাণ। এই পদোন্নতি যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে নাগরিকরা দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে।”

নারী বিচারকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই পদোন্নতির তালিকায় নারী বিচারকদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ জেলা জজ নারী। এবারের পদোন্নতিতে আরও কয়েক ডজন নারী বিচারক জেলা জজ পদে উন্নীত হয়েছেন।
এটি নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব বৃদ্ধির এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক সংস্কার

প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর অংশ হিসেবেই জেলা জজদের এই ব্যাপক পদোন্নতি এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগামী বছরে অধস্তন আদালতের পর্যায়ে আরও কিছু কাঠামোগত সংস্কার আনা হতে পারে।

জনগণের প্রত্যাশা

সাধারণ মানুষ আশা করছে, নতুন জেলা জজরা দায়িত্ব নেওয়ার পর মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়বে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণ দ্রুত রায় পাবে। দীর্ঘদিন ধরে যেসব মামলা বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে, সেগুলো নিষ্পত্তিতে নতুন গতি আসবে।

চট্টগ্রামের এক আইনজীবী বলেন,

“আমরা চাই, পদোন্নতি যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা না হয়। বিচারকেরা যেন সত্যিকারের ন্যায়বিচারের রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।”

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। তিন শতাধিক বিচারককে জেলা জজ পদে উন্নীত করা মানে বিচার প্রশাসনের এক নতুন যুগের সূচনা।
যদি এই পদোন্নতি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশের বিচার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী, দ্রুত ও জনবান্ধব হবে — যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি।

এই পদোন্নতি শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনাও বটে।
সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হলে দেশের নাগরিকরা আরও সহজে, দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে ন্যায়বিচার পাবে — এমনটাই প্রত্যাশা করছে পুরো জাতি।

MAH – 13618 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button