
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত এবং ভারতের নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সের্জিও গোর। সোমবার রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন, আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আশ্বাস
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিশেষ দূতকে আশ্বস্ত করেন যে, বাংলাদেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশের জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন, তার জন্য প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।”
ড. ইউনূস আরও উল্লেখ করেন, নির্বাচন হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইতিমধ্যেই সংলাপ ও আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস ও কূটনৈতিক বার্তা
বৈঠকে সের্জিও গোর বলেন, “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় গুরুত্ব দিয়ে দেখে। আমরা চাই বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক।” তিনি ড. ইউনূসের নেতৃত্ব ও উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি আরও জানান, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাস দমনের মতো বিষয়ে দুই দেশের সহযোগিতা আরও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয়গুলো
বৈঠকে প্রধানত যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে—
- জাতীয় নির্বাচন: নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ।
- দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক: বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং শ্রমবাজারের সম্ভাবনা।
- আঞ্চলিক রাজনীতি: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক কৌশল।
- গ্লোবাল ইস্যু: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, টেকসই উন্নয়ন এবং মানবিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার
ড. ইউনূস বৈঠকে বলেন, “গণতন্ত্রই আমাদের অগ্রযাত্রার ভিত্তি। নির্বাচন হবে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা দেশের মানুষকে নতুন আস্থার বার্তা দেবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবসময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক
বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। বাণিজ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। ২০২৪ সালে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের USAID এবং অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময়ই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার, রোহিঙ্গা সংকট, বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক কৌশল—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক এবং গণতন্ত্র সুদৃঢ় হোক। এতে কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নই নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।
নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে নির্বাচনকে ঘিরে সরব আলোচনা চলছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান জানাচ্ছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, সব পক্ষকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। তবে বিরোধী দলের দাবি, নির্বাচন যেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হয় এবং ভোটগ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
বৈঠকের তাৎপর্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. ইউনূস ও সের্জিও গোরের এই বৈঠক শুধু কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহের প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি সদিচ্ছা দেখালেও তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কড়া নজর রাখছে।
সফরের আমন্ত্রণ
বৈঠকের শেষদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সের্জিও গোরকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, “আমরা চাই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নিজের চোখে দেখুন, বাংলাদেশ কীভাবে স্বচ্ছ নির্বাচনের আয়োজন করছে।”
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূতের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশা শুধু জনগণের নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তিগুলোরও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।
MAH – 12961 I Signalbd.com