বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন পে স্কেল বা বেতন কাঠামো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, এবং আইএমএফের শর্ত পূরণের বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সরকার এ বিষয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, নতুন পে স্কেল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আগামী নির্বাচিত সরকার।
সরকারি কর্মচারীদের অপেক্ষা, সিদ্ধান্ত পরবর্তী সরকারের
রোববার (৯ নভেম্বর ২০২৫) দুপুরে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা বলেন,
“বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করছে। কিন্তু বড় কোনো আর্থিক সংস্কার—বিশেষ করে নতুন পে স্কেল—নির্বাচিত সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়বে। কারণ এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে অর্থ ছাড়ের আগে কিছু শর্ত দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার কীভাবে এসব শর্ত বাস্তবায়ন করে, তা দেখেই আইএমএফ পরবর্তী কিস্তি ছাড় করবে।”
অর্থনীতির বর্তমান চিত্র: মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, চালের দাম স্থিতিশীল
অর্থ উপদেষ্টা জানান, দেশের সার্বিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। যদিও কিছু খাতে মূল্যস্ফীতি আছে, তবে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে তুলনামূলক স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে।
তার ভাষায়, “চালের দাম এখন মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে পরিবহন ভাড়া ও বাড়ি ভাড়া কিছুটা বেড়েছে—এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবুও সার্বিক খাদ্য পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলা যায়।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, অক্টোবরের শেষে দেশে গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৮.৩ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় সামান্য হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাদ্য খাতে মূল্যবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও, অখাদ্য খাত—বিশেষ করে বাসা ভাড়া, পরিবহন ও চিকিৎসা খাতে—খরচ বেড়েছে।
খাদ্য উপদেষ্টার ঘোষণা: নভেম্বর থেকে ধান-চাল ক্রয় শুরু
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। তিনি জানান, সরকার নভেম্বর থেকেই নতুন ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করবে।
তিনি বলেন, “খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে—নভেম্বর থেকে ৩৪ টাকা কেজি দরে ধান, ৫০ টাকা দরে সিদ্ধ চাল এবং ৪৯ টাকা দরে আতপ চাল কেনা হবে।”
আলী ইমাম মজুমদার আরও জানান, “এ বছর ৫০ হাজার টন আমন ধান, ৫০ হাজার টন আতপ চাল এবং ৬ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”
কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের প্রস্তুতি
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ধান উৎপাদন ভালো হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়া ও সার-বীজের সহজলভ্যতার কারণে কৃষকেরা এবার ভালো ফলনের আশা করছেন।
তবে বাজারে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা না গেলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন—এ বিষয়টিও সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে।
একজন জেলা খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, “সরকারি ধান ক্রয়ের ঘোষণা কৃষকের জন্য আশার বার্তা। এতে বাজারে বেসরকারি ব্যবসায়ীরাও দাম কমাতে পারবে না।”
নতুন পে স্কেলের প্রস্তাব: কোথায় থেমে আছে আলোচনা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছিল।
২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে গঠিত প্রস্তাবনায় সুপারিশ করা হয়েছিল যে,
বর্তমান বেতন কাঠামোর সর্বনিম্ন গ্রেডে ৩০-৩৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ গ্রেডে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি করা হতে পারে।
তবে অর্থনৈতিক চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং আইএমএফের কাঠামোগত শর্তের কারণে এই প্রক্রিয়া থমকে যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এই ধরনের বড় আর্থিক সংস্কার নেওয়া “যুক্তিযুক্ত নয়”।
আইএমএফের শর্ত ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
২০২২ সালে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন পায়।
এই ঋণের কিস্তি ছাড়ের শর্ত হিসেবে আইএমএফ কয়েকটি বিষয়ে জোর দিয়েছে—
যেমন, কর আদায় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাস্তবসম্মত করা, এবং সরকারি খরচে স্বচ্ছতা আনা।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে আমরা যেন সাধারণ মানুষের জীবনে চাপ সৃষ্টি না করি, সে দিকেও সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচিত সরকারই এই ভারসাম্য রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”
সরকারি চাকরিজীবীদের প্রত্যাশা
সরকারি চাকরিজীবীরা নতুন পে স্কেলের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের দাবি, গত পে স্কেলটি ঘোষণা হয়েছিল ২০১৫ সালে, যা কার্যকর হয় ২০১৬ সাল থেকে। প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন,
“আমরা আশা করি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত একটি বাস্তবসম্মত পে স্কেল ঘোষণা করবে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আগের বেতন কাঠামো দিয়ে সংসার চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।”
বিশেষজ্ঞদের মত: অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আগে, পরে সংস্কার
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন,
“বেতন কাঠামো বাড়ালে তা স্বল্পমেয়াদে জনগণের জন্য ইতিবাচক হতে পারে, কিন্তু রাজস্ব ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়াতে পারে। তাই এখন অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করাটাই সবচেয়ে জরুরি।”
নির্বাচনের পর কী হতে পারে
নির্বাচনের পর গঠিত সরকার পে কমিশন গঠন করতে পারে—এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সাধারণত প্রতি ১০ বছরে একবার সরকার নতুন পে স্কেল ঘোষণা করে থাকে।
নির্বাচিত সরকার চাইলে ২০২৬ সালের শুরুতেই একটি “নবম পে কমিশন” গঠন করে নতুন কাঠামোর প্রস্তাব দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের সিদ্ধান্তটি সতর্ক ও বাস্তবসম্মত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নতুন পে স্কেল নিয়ে প্রত্যাশা থাকলেও, এখন মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের জীবনযাত্রার মান টেকসই রাখা।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে সেই বার্তাই স্পষ্ট—
“নির্বাচিত সরকারই দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি ও পে স্কেল নির্ধারণ করবে।”
MAH – 13706 I Signalbd.com



