বানিজ্য

আমদানি হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান

Advertisement

দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম আবারও বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা বিপাকে পড়েছেন। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে এখনো পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত আছে এবং চলতি মাসেই নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসছে। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং বাজারে কারসাজির কারণে দামের লাগাম টেনে রাখা যাচ্ছে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ভারতীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কম থাকলেও সীমান্তে বড় আকারে ভারতীয় পেঁয়াজ মজুত করা হয়েছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সেই পেঁয়াজ আমদানির আশায় দেশীয় বাজারে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে, যাতে আমদানির অনুমতি পেলেই তারা মোটা অঙ্কের মুনাফা করতে পারে।

দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত, তবু বাজারে অস্থিরতা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে আগের মৌসুমের প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ এখনো মজুত আছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি নভেম্বরেই প্রায় ১ লাখ টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসবে। ডিসেম্বর মাসে আরও ২ লাখ ৫ হাজার টন নতুন পেঁয়াজ আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তাহলে প্রশ্ন উঠছে—যখন দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আছে, তখন হঠাৎ এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বাজার কারসাজির একটি ক্লাসিক উদাহরণ। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে একটি প্রভাবশালী মহল বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।

ভারতে দাম কম, তাই লাভের আশায় কৃত্রিম সংকট

ভারতের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৮ রুপি, অর্থাৎ প্রায় ১২ টাকা। সেখানে থেকে আমদানি করলে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সহজেই লাভবান হবেন, কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন,

“ভারতীয় বাজারে দাম এত কম যে এখন আমদানি শুরু করলে দেশের কৃষকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। আমরা দেশের কৃষকদের ক্ষতি করে বিদেশি ব্যবসায়ীদের লাভবান হতে দিতে পারি না।”

ফলে বাণিজ্য, কৃষি ও ট্যারিফ কমিশনের যৌথ বৈঠকে আপাতত পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।

সরকারি অভিযানে পাইকারিতে কিছুটা স্বস্তি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ টিম ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ীসহ প্রধান উৎপাদন অঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছে। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানের পর পাইকারি পর্যায়ে মণপ্রতি দাম ২৫০ টাকার বেশি কমেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন,

“আমাদের দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই, বরং কারসাজির কারণে দাম বেড়েছে। আমরা বাজারে মনিটরিং টিম পাঠিয়েছি, এতে পাইকারি দামে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। তবে খুচরায় দাম কমছে না কেন, সেটি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।”

তিনি আরও বলেন,

“এখন যদি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে দেশের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না।”

চাহিদা, উৎপাদন ও নষ্ট হওয়া পেঁয়াজের হিসাব

বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। গত মৌসুমে দেশে ৩৮ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মৌসুমের শেষে ঘাটতি পূরণে আমদানির প্রয়োজন হয়।

সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, শনিবার রাজধানীর বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে, যেখানে এক সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৭০-৮০ টাকা


ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ: কৃত্রিম সংকট ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য

সরকারের ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) বলছে, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী বিপুল মুনাফা করছে। কমিশনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে,

“বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকার মধ্যে থাকা উচিত ছিল, কিন্তু কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে তা বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছেছে।”

তবে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কমিশন ‘স্বল্প পরিসরে আমদানির’ সুপারিশ করেছে। তাদের মতে, এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং বাজারে ভারসাম্য ফিরবে।

পূর্ববর্তী সুপারিশ ও সরকারের অবস্থান

এর আগেও, গত ৪ সেপ্টেম্বর, যখন ডিমের দাম প্রতি ডজন ১৫০ টাকা এবং পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকার ওপরে পৌঁছেছিল, তখন ট্যারিফ কমিশন শুল্কছাড়সহ আমদানির অনুমতির প্রস্তাব দিয়েছিল।

তবে এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, বাজারে পর্যাপ্ত মজুত আছে এবং নতুন ফসল আসছে—এমন পরিস্থিতিতে আমদানির সিদ্ধান্ত কৃষকদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।

অর্থনীতিবিদদের মতামত: “আগেই পরিকল্পনা করা দরকার ছিল”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন,

“প্রতি বছর এই সময়টাতে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়ে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই বছর দামের ঊর্ধ্বগতি অস্বাভাবিক। আমদানির পরিকল্পনা যদি এক মাস আগেই করা হতো, তাহলে এখন এই অবস্থায় পড়তে হতো না।”

তিনি আরও বলেন,

“বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে দেশে পর্যাপ্ত মজুত আছে, কিন্তু বাস্তবে বাজারের চিত্র ভিন্ন। দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সীমিত আকারে পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে।”

কৃষকের দৃষ্টিকোণ: ক্ষতির আশঙ্কা

দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, আমদানি খুলে দিলে বাজারে হঠাৎ দাম পড়ে যাবে, ফলে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন।

পাবনার চাটমোহরের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন,

“আমরা এখনো আগের বছরের কিছু পেঁয়াজ ধরে রেখেছি। নতুন ফসল তুলতে যাচ্ছি। এখন যদি ভারত থেকে পেঁয়াজ আসে, আমাদের দাম একেবারে পড়ে যাবে। তাহলে আর টিকতে পারব না।”

ভোক্তাদের ক্ষোভ ও আশার আলো

রাজধানীর খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি সাধারণ ক্রেতাদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে। মিরপুরের গৃহিণী শবনম আক্তার বলেন,

“দুই সপ্তাহ আগেও ৭০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছি, এখন ১২০ টাকায় দিচ্ছে। সংসারের বাজেট মেলানো কঠিন হয়ে গেছে।”

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমের অভিযান শুরু হওয়ায় ভোক্তারা আশা করছেন, কয়েক দিনের মধ্যে দাম স্বাভাবিক হবে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ: বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের দাবি

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু অভিযান চালিয়ে বা অস্থায়ী আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। দরকার দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা—যেখানে সংরক্ষণ, পরিবহন, বাজার পর্যবেক্ষণ এবং মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন,

“দেশীয় কৃষিপণ্যের বাজারে স্বচ্ছতা আনতে না পারলে প্রতিবছরই এমন অস্থিরতা দেখা দেবে। তাই উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার ‘সতর্ক’ অবস্থানে রয়েছে। একদিকে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা, অন্যদিকে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য—এই দুই দিক সামলানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

বাজারে পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকটের কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়া আমাদের বাজারব্যবস্থার দুর্বলতারই প্রতিফলন। অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সঠিক সময়ের পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে এমন অস্থিতিশীলতা রোধ করা সম্ভব।

MAH – 13685 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button