বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা (FIFA) এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে—প্রথমবারের মতো চালু করতে যাচ্ছে ‘ফিফা পিস প্রাইজ’ বা ফিফা শান্তি পুরস্কার। এই পুরস্কারটির লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া।
আগামী ৫ ডিসেম্বর ২০২৬ সালে বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার প্রদান করবে ফিফা। ২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডা জুড়ে, যা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বকাপ আয়োজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ফিফা শান্তি পুরস্কার: বিশ্ব ফুটবলে নতুন অধ্যায়
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে অনুষ্ঠিত আমেরিকা বিজনেস ফোরাম-এ এই ঘোষণা দেন। ইনফান্তিনো বলেন,
“ক্রমবর্ধমান অস্থির ও বিভাজিত বিশ্বে যারা শান্তি ও ঐক্যের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছেন, তাদের স্বীকৃতি জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিফা বিশ্বাস করে—ফুটবল মানুষকে একত্র করে, বিভেদ নয়, বন্ধন গড়ে।”
ফিফার ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। প্রথমবার এটি ইনফান্তিনোর হাতেই প্রদান করা হবে, এরপর থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ভক্তদের অংশগ্রহণে মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে দেওয়া হবে এই পুরস্কার।
ট্রাম্পের নাম কি আসছে প্রথম ফিফা শান্তি পুরস্কারের তালিকায়?
এই ঘোষণার পর থেকেই ক্রীড়া বিশ্বে জোর গুঞ্জন—প্রথম ফিফা শান্তি পুরস্কারটি কি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে উঠতে যাচ্ছে?
মায়ামির সেই অনুষ্ঠানে ইনফান্তিনোকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়—পুরস্কারটি কি ট্রাম্পের জন্যই ভাবা হয়েছে? ইনফান্তিনো কৌশলী হাসি দিয়ে উত্তর দেন,
“৫ ডিসেম্বর আপনারাই দেখবেন।”
এই এক বাক্যেই যেন জল্পনা আরও বেড়ে যায়। ট্রাম্পও ওই একই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতার পর ফিফা সভাপতির সঙ্গে তাঁর হাসিমুখে কথোপকথনের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ইনফান্তিনো-ট্রাম্প: বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার গল্প
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সাল থেকেই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যখন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডা যৌথভাবে ২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের বিড জেতে।
ইনফান্তিনো অনুষ্ঠানে স্বীকার করেন,
“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বিশ্বকাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে ফিফাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছেন। আমি তাঁকে সত্যিই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করি।”
ফিফার একাধিক প্রকল্পে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণ, নিরাপত্তা নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার মতো কাজে ট্রাম্প প্রশাসনের অবদান উল্লেখযোগ্য ছিল।
ইভাঙ্কা ট্রাম্পও ফিফার সঙ্গে যুক্ত
ফিফা সম্প্রতি ট্রাম্প পরিবারের সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ফিফার শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক একটি প্রকল্পে ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্পকে বোর্ড সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের লক্ষ্য—২০২৬ বিশ্বকাপ থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি অংশ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ফুটবলভিত্তিক শিক্ষা উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রায় ১০ কোটি ডলারের এই প্রকল্প পরিচালিত হবে ফিফার সামাজিক দপ্তরের তত্ত্বাবধানে।
ট্রাম্প ও শান্তির নোবেল পুরস্কার প্রসঙ্গ
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে শান্তি পুরস্কার ঘিরে বিতর্ক নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই ট্রাম্প নিজেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে দাবি করে আসছেন।
২০২০ সালে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি আলোচনায় ভূমিকা রাখার জন্য তাঁর নাম নোবেলের আলোচনায় আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন পাননি। সাম্প্রতিক মাসেও রিপাবলিকান পার্টির কয়েকজন নেতা ও কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন তাঁর জন্য সুপারিশ করলেও, নোবেল কমিটি তাঁকে বিবেচনায় নেয়নি।
এ কারণেই অনেকে মনে করছেন, ফিফার নতুন ‘শান্তি পুরস্কার’ ট্রাম্পের প্রতি ইনফান্তিনোর এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্মাননা হতে পারে।
ফিফার উদ্দেশ্য: ফুটবল দিয়ে ঐক্য ও মানবতা প্রতিষ্ঠা
তবে ফিফার বক্তব্য অনুযায়ী, এই পুরস্কার সম্পূর্ণভাবে মানবিক মূল্যবোধ ও বৈশ্বিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই দেওয়া হবে। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়,
“ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়; এটি হলো ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতির সীমানা পেরিয়ে মানুষকে একত্রিত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম।”
ইনফান্তিনো আরও বলেন,
“আমরা বিশ্বাস করি—ফুটবল যখন একত্রিত করে, তখন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। এই পুরস্কারের মাধ্যমে আমরা সেই সব মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।”
বিশ্বকাপ ড্র হবে শান্তির প্ল্যাটফর্মে
আগামী ৫ ডিসেম্বর ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ ড্র অনুষ্ঠান। ইনফান্তিনোর ভাষায়,
“বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠানই সেই আদর্শ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে সম্মান জানাতে পারব, যিনি শান্তির জন্য অসাধারণ কিছু করেছেন।”
এ অনুষ্ঠান হবে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। ফিফা জানিয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখতে পারবেন।
ফিফা শান্তি পুরস্কারের উদ্দেশ্য ও মানদণ্ড
‘ফিফা পিস প্রাইজ’ কেবল কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নয়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের শান্তি–অগ্রদূতদেরও দেওয়া হতে পারে।
ফিফা সূত্রে জানা গেছে, সম্ভাব্য মনোনীতদের মধ্যে থাকতে পারেন আন্তর্জাতিক সংস্থার মানবিক কর্মী, ফুটবল খেলোয়াড়, সমাজসেবক এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে কাজ করা সংগঠনগুলোও।
পুরস্কারের মূল স্লোগান—“Football Unites the World” (ফুটবল মানুষকে এক করে)—যা ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের মূল থিম থেকেও অনুপ্রাণিত।
ফুটবল ও শান্তি: ইতিহাসে নজির
ফুটবল ইতিহাসে শান্তির অনন্য উদাহরণ রয়েছে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ‘ক্রিসমাস ট্রুস’-এর সময় জার্মান ও ব্রিটিশ সেনারা বন্দুক নামিয়ে ফুটবল খেলেছিল একসঙ্গে।
আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টেও ফুটবল শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, যখন তারকা খেলোয়াড় দিদিয়ের দ্রগবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তির আহ্বান জানান এবং গৃহযুদ্ধের অবসানে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফিফা মনে করে, এই ইতিহাসই প্রমাণ করে—ফুটবল সত্যিই শান্তির সেতুবন্ধন হতে পারে।
বিশ্বকাপ ২০২৬: শান্তি, ঐক্য ও নতুন দিগন্ত
২০২৬ বিশ্বকাপ হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট—৪৮ দল অংশ নেবে, তিনটি দেশে ছড়িয়ে পড়বে খেলাগুলো। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফিফা ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার’ ধারণাকে সামনে আনতে চায়।
ইনফান্তিনো বলেন,
“আমরা এমন এক বিশ্বকাপ আয়োজন করছি যা শুধু ফুটবল নয়, শান্তি ও ঐক্যের প্রতীক হবে। মাঠে যেমন প্রতিযোগিতা, তেমনি মাঠের বাইরে থাকবে ভালোবাসা ও মানবতার জয়।”
ফিফার এই নতুন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে সমালোচকরা মনে করছেন, যদি প্রথম পুরস্কারটি সত্যিই ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে তোলা হয়, তবে সেটি ফিফার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। আবার অনেকে বলছেন, যদি এটি শান্তির প্রতীক হিসেবেই দেওয়া হয়, তাহলে রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবিকতার জয় হবে।
যাই হোক, এখন ফুটবল–বিশ্বের চোখ ৫ ডিসেম্বরের দিকে—সেই দিনই জানা যাবে, কার হাতে উঠবে ইতিহাসের প্রথম ‘ফিফা শান্তি পুরস্কার’।
MAH – 13657 I Signalbd.com



