শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায় সরকারি দপ্তরে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। উপজেলা কৃষি অফিসে দায়িত্ব পালনরত কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার মোরসালিনকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ছাত্রদলের সদস্যসচিব রাহাত হাসান কাইয়ুম (৩৫) ও তার সহযোগী ছাত্রনেতা ফজলুল হক (৩২)-এর বিরুদ্ধে।
ঘটনাটি ঘটে বুধবার (৫ নভেম্বর) দুপুরে। রাতেই ভুক্তভোগী কর্মকর্তা নকলা থানায় মামলা দায়ের করেন। ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়।
কী ঘটেছিল কৃষি অফিসে
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, বুধবার দুপুরে নকলা উপজেলা কমপ্লেক্সের কৃষি অফিসে প্রবেশ করেন ছাত্রদলের সদস্যসচিব রাহাত হাসান কাইয়ুম ও তার সহযোগী ফজলুল হকসহ আরও কয়েকজন। তারা ওই সময় কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার মোরসালিনের কাছে সরকারি প্রণোদনা কর্মসূচির তালিকা দেখতে চান এবং জানতে চান—কোন “নেতাকে” কত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রণোদনা কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে কৃষকদের নামের তালিকা অনুযায়ী পরিচালিত হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রাহাত ও তার সহযোগীরা। তারা কর্মকর্তার সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন এবং তাঁকে নকলা থেকে “তাড়িয়ে দেওয়ার” হুমকি দেন।
এরপর তারা কৃষি কর্মকর্তার ওপর শারীরিক আক্রমণ করেন—ধাক্কাধাক্কি, চুল ধরে টানা, এবং গায়ে হাত তোলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্মকর্তার চিৎকার শুনে দপ্তরের অন্যান্য কর্মচারীরা ছুটে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে সহকর্মীরা আহত শাহরিয়ার মোরসালিনকে দ্রুত নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল
ঘটনার কিছুক্ষণ পর অফিসে থাকা কর্মচারীদের একজন মোবাইল ফোনে তোলা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, একদল যুবক কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন, পরে শারীরিকভাবে আক্রমণও করেন। ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তেই সমালোচনার ঝড় ওঠে।
স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। অনেকেই মন্তব্য করেন, “সরকারি কর্মকর্তাকে দপ্তরে মারধর করা প্রশাসনের প্রতি চরম অবমাননা।”
ছাত্রদল নেতাদের ফোন বন্ধ
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে অভিযুক্ত দুই ছাত্রদল নেতার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়, তবে দু’জনের ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়।
তাদের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয়, তবে সূত্র জানায়—ঘটনার পরপরই তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।
ছাত্রদল আহ্বায়কের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নকলা উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাসেল সরকার বলেন,
“ভিডিওটি আমি নিজেও দেখেছি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয় কাজ। ছাত্রনেতা হয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দলের পক্ষ থেকে এমন ঘটনার দায় আমরা নেব না, এবং কেউ দোষী প্রমাণিত হলে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ছাত্রদল সবসময় জনগণের পাশে থেকেছে, কিন্তু এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ দলীয় নীতির পরিপন্থী।”
আইনি ব্যবস্থা ও পুলিশের অবস্থান
নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান বলেন,
“ভুক্তভোগী কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার মোরসালিনের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার রাতে মামলা নেওয়া হয়েছে। মামলায় রাহাত হাসান কাইয়ুম ও ফজলুল হককে প্রধান আসামি করা হয়েছে। অভিযোগের ধরণ অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে সরকারি কাজে বাধা, হুমকি ও শারীরিক আঘাতের ধারায়।”
তিনি আরও জানান, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পুলিশের একাধিক টিম ইতিমধ্যে মাঠে কাজ করছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
ঘটনাটি শুধু শেরপুর নয়, সারাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশ প্রশাসনিক পরিষদের স্থানীয় এক সদস্য বলেন,
“কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো চাপে নিরাপদে কাজ করতে না পারেন, তাহলে উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। কৃষি খাতের প্রণোদনা কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে এমন ঘটনাগুলো দৃষ্টান্তমূলকভাবে দমন করতে হবে।”
কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি কী এবং কেন বিতর্ক
সরকার প্রতিবছর কৃষকদের সহায়তার জন্য কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নেয়, যাতে কৃষি উৎপাদন বাড়ে এবং ক্ষুদ্র কৃষকরা উৎসাহিত হন। এ কর্মসূচিতে সাধারণত বীজ, সার, ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া হয়।
কিন্তু বহু জায়গায় এই প্রণোদনা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে—“দলীয় প্রভাব”, “তালিকায় অনিয়ম” ও “প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম সংযোজন” ইত্যাদি বিষয়ে।
নকলা উপজেলার ঘটনার পর এসব অভিযোগ আবারও আলোচনায় এসেছে।
একজন স্থানীয় কৃষক বলেন,
“প্রতি বছর প্রণোদনার সময় অনেক নেতা-কর্মী এসে কৃষকের তালিকা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। এবারও সেই চেষ্টা হয়তো হয়েছে, কিন্তু কর্মকর্তা সাহস করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন, এজন্যই হয়তো তাকে মারধর করা হয়েছে।”
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন,
“যে সমাজে সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক চাপের কারণে নিরাপত্তাহীন বোধ করেন, সেখানে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার দ্রুত বিচার হওয়া উচিত, যাতে অন্য কেউ এমন সাহস না পায়।”
তিনি আরও বলেন,
“প্রশাসনের লোকদের প্রতি আস্থা ও মর্যাদা রক্ষা না হলে উন্নয়ন কার্যক্রম টেকসই হবে না।”
ঘটনার প্রভাব ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর থেকে নকলা উপজেলা কমপ্লেক্স এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে অফিস এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে।
অনেক সরকারি কর্মকর্তা এখন দপ্তরে প্রবেশে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন,
“এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রশাসনিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ইতিমধ্যেই পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করেছি।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেন,
“এই হামলা শুধু একজন কর্মকর্তার ওপর নয়, পুরো সরকারি প্রশাসনের ওপর হামলা। দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।”
এদিকে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন,
“আমরা বিষয়টি জানার চেষ্টা করছি। যদি কেউ সংগঠনের নামে ব্যক্তিগত স্বার্থে এমন কাজ করে থাকে, তার দায় সংগঠন নেবে না।”
ঘটনার বর্তমান অবস্থা
মামলা দায়েরের পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার হয়নি, তবে পুলিশ বলছে—অভিযুক্তদের অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা শাহরিয়ার মোরসালিন বর্তমানে সুস্থ আছেন, তবে তিনি জানিয়েছেন, “এই ঘটনার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি শুধু চাই, এমন ঘটনা যেন আর কোনো সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে না ঘটে।”
ন্যায়ের প্রত্যাশা ও শাস্তির দাবি
নকলা উপজেলার এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে, রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্পর্ক কতটা সংবেদনশীল। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি আস্থা ও সম্মান বজায় রাখতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই লিখেছেন—
“একজন কর্মকর্তাকে দপ্তরে মারধর মানে প্রশাসনের মর্যাদাকে আঘাত করা। দোষীদের শাস্তি না হলে এমন ঘটনা আরও বাড়বে।”
দেশজুড়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এখন একটাই দাবি তুলেছেন—“নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।”
MAH – 13643 I Signalbd.com



