দীর্ঘদিনের আলোচনার পর অবশেষে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে ১৫ দিনের বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরেই তিনি জানিয়েছেন— “খুব শিগগিরই জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দলীয় প্রার্থীদের ঘোষণা করবে।”
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিদেশ সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন
ভোরের ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি পবিত্র উমরা পালন শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সফর করেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন তিনি।
বিমানবন্দরে পৌঁছে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন।
“খুব শিগগিরই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডা. শফিকুর রহমান বলেন,
“আমরা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ করেছি। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই খুব শিগগিরই আমরা দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করব।”
তিনি আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী জনগণের দল। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই তারা সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক প্রার্থী বাছাই করছেন।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার রেজিস্ট্রেশন সময় বাড়ানোর দাবি
জামায়াত আমির আরও বলেন, অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক নির্বাচনে অংশ নিতে চান কিন্তু রেজিস্ট্রেশন সময় সীমিত থাকায় তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
“আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করছি, প্রবাসীদের ভোটাধিকার রেজিস্ট্রেশনের সময় কমপক্ষে আরও ১৫ দিন বাড়ানো হোক, যাতে তারা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন,” — বলেন তিনি।
এই বক্তব্যের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই জামায়াতের এই দাবিকে সময়োপযোগী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
‘মতানৈক্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’ — ডা. শফিকুর রহমান
রাজনৈতিক মতভেদের প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির বলেন,
“মতানৈক্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বিভিন্ন দলে বিভিন্ন মত থাকবে, তবে সেটি যেন বিভাজন বা শত্রুতা সৃষ্টি না করে।”
তিনি আরও বলেন, দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সকল রাজনৈতিক দলকে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। পারস্পরিক সম্মান ও সহনশীলতার মাধ্যমেই একটি শক্তিশালী জাতি গঠিত হতে পারে।
গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান
ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন,
“গণমাধ্যম জাতির বিবেক। আগামীর বাংলাদেশ গড়তে আপনাদের ভূমিকা অপরিসীম। সত্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী সাংবাদিকতা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।”
তিনি গণমাধ্যমকে দেশের উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কাজ করার আহ্বান জানান।
জামায়াতের নতুন কৌশল ও রাজনৈতিক অবস্থান
গত কয়েক বছর ধরে নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে জামায়াতে ইসলামী অনেকটা নীরব ভূমিকায় ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দলটি নতুন করে সাংগঠনিক কাঠামো সাজাচ্ছে বলে জানা গেছে।
দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, জামায়াত এবার স্বাধীনভাবে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে, যদিও এখনো কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত যদি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে তারা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে জামায়াতের ভোটব্যাংক এখনো সক্রিয়।
প্রেক্ষাপট: জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যক্রম
গত কয়েক মাস ধরে জামায়াতে ইসলামী দেশজুড়ে নানা মানবিক ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিক্ষা সহায়তা, ত্রাণ বিতরণ, এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে তারা তরুণ প্রজন্মের কাছে পুনরায় জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে।
দলটি দাবি করছে, তাদের নতুন নেতৃত্ব ‘সহনশীল রাজনীতি’ ও ‘নৈতিক রাজনীতির’ ধারা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ও জামায়াতের সম্ভাবনা
২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ইতোমধ্যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল— আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। এ অবস্থায় জামায়াতের সক্রিয়তা নতুন মাত্রা যোগ করেছে নির্বাচনী রাজনীতিতে।
জামায়াতের প্রার্থী ঘোষণার পর রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অনেকের মতে, জামায়াত স্বাধীনভাবে নির্বাচন করলে বিএনপি-জামায়াত জোটের পুরনো কাঠামো ভেঙে যেতে পারে, আবার নতুন কোনও রাজনৈতিক জোটও গঠিত হতে পারে।
দলের নীতিগত অবস্থান
জামায়াতে ইসলামী সব সময়ই ইসলামভিত্তিক সমাজ গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তারা “ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই ইসলামিক মূল্যবোধের রাজনীতি” চালিয়ে যেতে চান।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন,
“আমরা বিশ্বাস করি— রাজনীতি মানে মানুষের সেবা। ইসলামের ন্যায়ের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনই আমাদের লক্ষ্য।”
নতুন প্রজন্মের প্রতি বার্তা
দেশে ফিরে জামায়াত আমির তরুণদের উদ্দেশে বিশেষ বার্তা দেন। তিনি বলেন,
“তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ। নৈতিকতা, জ্ঞান ও দেশপ্রেম দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। নীতিহীন রাজনীতি বা বিভাজন নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠুক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।”
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, জামায়াতের এই নতুন তৎপরতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দলটি আগামী নির্বাচনে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে চায়। তবে তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিবন্ধন ইস্যু এবং রাজনৈতিক স্বীকৃতি।
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. নূরুল ইসলাম বলেন,
“যদি জামায়াত আইনগত জটিলতা কাটিয়ে সংগঠনকে পুনরায় সক্রিয় করতে পারে, তবে তাদের পুরনো ভোটারদের অনেকেই আবার ফিরে আসবে।”
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে জামায়াত
সাম্প্রতিক সফরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে জামায়াত নেতারা প্রবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। জানা গেছে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা জামায়াতকে “দেশে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের একটি সম্ভাব্য বিকল্প” হিসেবে দেখছেন।
দলটির আন্তর্জাতিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে জামায়াতের অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যক্রমও বাড়ানো হয়েছে।
ডা. শফিকুর রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন এবং দলীয় প্রার্থী ঘোষণা সংক্রান্ত বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে— জামায়াতে ইসলামী এখন আর দর্শকের ভূমিকায় নেই, বরং তারা সক্রিয় রাজনীতির মাঠে ফিরতে প্রস্তুত।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটির পদক্ষেপ এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
দেশের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ গঠনে জামায়াতের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে, তা এখন নজর রাখছে গোটা জাতি।
MAH – 13604 I Signalbd.com



