ডেঙ্গুতে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্ধেক রোগীর মৃত্যু, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কতা

চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুতে এক উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১১৪ জন রোগীর মধ্যে অর্ধেক রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন। দেরিতে চিকিৎসা নেওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগ উল্লেখ করেছে।
মহাখালী স্বাস্থ্য ভবনে সোমবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. হালিমুর রশিদ এই তথ্য জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।
চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি: মৃত্যু ও সংক্রমণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমেছে। গত বছর যেখানে মৃত্যুহার ছিল ০.৭৫%, চলতি বছর তা দাঁড়িয়েছে ০.৪৩%।
ঢাকা এবং বরগুনা জেলায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। ১১৪ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৩ জন, আর কুর্মিটোলা হাসপাতালে ১৪ জন মারা গেছেন।
ডা. হালিমুর রশিদ জানান, মৃতদের মধ্যে ৫৭ জন অর্থাৎ ৫০ শতাংশ মারা গেছেন ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। আরও ৭৮ জন মারা গেছেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, আর ৫ শতাংশ মারা গেছেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে। বাকি রোগীরা পরবর্তীতে মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর সংখ্যা সমান, প্রতিটি লিঙ্গে ৫০%।
মৃত্যুর প্রধান কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগী
ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো শক সিনড্রোম। মৃতদের ৫৬ শতাংশ এই কারণে মারা গেছেন। এছাড়া ৪০ শতাংশ রোগীর শরীরে অন্যান্য জটিল রোগ ছিল, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ডা. হালিমুর রশিদ আরও বলেন, গড়ে মৃত্যুর সময় ছিল আড়াই দিন, এবং অধিকাংশ রোগী ৩ থেকে ৬ দিনের মধ্যে জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসেন।
বয়সভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগ ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী। এই বয়সের মধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন। এছাড়া শূণ্য থেকে ১০ বছর বয়সী ১৬ জন শিশুও মৃত্যু তালিকায় রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মন্তব্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, “জুলাই মাস থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে, চলতি সেপ্টেম্বরে প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ জন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার সরকারি ছুটির কারণে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়নি, যার ফলে সাময়িক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তবে ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি নেই, কিট বা স্যালাইনের কোনো সংকট নেই।”
তিনি আরও বলেন, “ডেঙ্গুর মৃত্যুর পর্যালোচনা আমাদের দেখিয়েছে, বেশিরভাগ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাচ্ছেন। শিশু ও বৃদ্ধদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং একাধিক জটিল রোগ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অসুখের কারণে মৃত্যুর হার পরিবর্তিত হয়।”
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্ব দিচ্ছেন:
- অতিরিক্ত জল জমে থাকা বন্ধ করা – এডিস মশা যেখানে জন্মায়, সেখানে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
- মশারি ও দেহ ঢাকা রাখা – রাতে এবং সকাল-সন্ধ্যার সময়ে মশার কামড় এড়াতে পোশাক ঢেকে রাখা জরুরি।
- পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা – বাসার আশেপাশে কোনো বাঁশের নালা, কুয়ো বা পাত্রে পানি জমে থাকলে তা দ্রুত ফেলা।
- তাজা খাবার ও পানির দিকে মনোযোগ – শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা।
- ডেঙ্গুর উপসর্গ চিনতে পারা – হঠাৎ জ্বর, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, পেটব্যথা, বমি বা রক্তপাত হলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া।
অন্য দেশের উদাহরণ
- থাইল্যান্ড: ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দ্রুত ব্যবস্থা নিলে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
- সিঙ্গাপুর: নিয়মিত মশক নিধন অভিযান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি মৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করছে।
- ভারত: শহরাঞ্চলে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ সতর্কতা জারি করেছে।
বাংলাদেশেও এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্রুত হাসপাতাল ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করলে মৃত্যুর হার আরও কমানো সম্ভব।
ডেঙ্গু: সতর্কবার্তা ও সাম্প্রতিক প্রকোপ
২০২৫ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরে ঢাকা, বরগুনা, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা জেলায় ডেঙ্গু প্রকোপ বেশি। বিশেষ করে ঢাকায় শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা এবং বাসা ও অফিসে মশা দমন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত হওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত কিট ও স্যালাইন রাখা হয়েছে, যাতে জরুরি অবস্থায় রোগী সঠিক চিকিৎসা পান।
ডেঙ্গু একটি প্রাণঘাতী, কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য রোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতাল ভর্তির অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর হার কমানোর জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা অপরিহার্য।
জনসচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মশা নিধন এবং সঠিক সময়ে হাসপাতালে যাওয়া এই রোগের মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
MAH – 12956 I Signalbd.com