কর্মসংস্থান

বিদেশগামী শ্রমিকদের সফলতার চাবিকাঠি: প্রস্তুতি, সিভি ও নিরাপদ অভিবাসন

Advertisement

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকরা এক অবিচ্ছেদ্য শক্তি। বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স অর্থাৎ প্রবাসী আয় দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে কোটি কোটি মানুষের কঠোর শ্রম ও উৎসর্গ। প্রশ্ন হলো, এই শ্রমিকরা কতটা প্রস্তুত এবং তাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা ও সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে কি না?

বিদেশ যাওয়া মানেই শুধু দেশ ছাড়া নয়, একটি বড় আর্থিক বিনিয়োগও। ভিসার ফি, এজেন্ট ফি, টিকিট, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু অনেকেই যথাযথ তথ্য ও প্রস্তুতির অভাবে বঞ্চিত হন সুযোগ থেকে। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে জানাবো কীভাবে একজন প্রবাসী শ্রমিক নিজের জন্য সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারেন, সিভির গুরুত্ব, দালালের হাত থেকে বাঁচার উপায় এবং নিরাপদ অভিবাসনের টিপস।

ভালো সিভি কেন অত্যন্ত জরুরি?

সিভি বা জীবনবৃত্তান্ত হলো আপনার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার সবচেয়ে কার্যকর পরিচয়পত্র। ভালো সিভি থাকলে বিদেশি নিয়োগদাতারা আপনার প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং ভালো বেতনের চাকরির সুযোগও বেশি পায়। শুধু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীদের জন্য নয়, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, চালক কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর জন্যও সিভি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজকের বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা অনেক কঠোর, এবং নিয়োগদাতারা কাঠামোবদ্ধ তথ্য ভিত্তিক কর্মী নির্বাচন করতে চান।

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যেমন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), প্রবাসীদের জন্য ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপে সহজ ও বিনামূল্যের সিভি তৈরির সুযোগ দিচ্ছে। এতে নাম, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভাষাজ্ঞান, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি তথ্য সহজে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

স্মার্টফোন দিয়ে সিভি বানানো এখন অনেক সহজ

আপনার কাছে যদি স্মার্টফোন থাকে, তবে আপনি সহজেই ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের মাধ্যমে বাংলায় বা ইংরেজিতে সুন্দর ও পেশাদার সিভি তৈরি করতে পারবেন। এই চ্যাটভিত্তিক সিভি বিল্ডার ব্যবহার করলে আপনাকে আলাদা সফটওয়্যার ডাউনলোডের প্রয়োজন হবে না। এতে আপনার সকল প্রয়োজনীয় তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। এর ফলে দালালের ওপর নির্ভরতা কমে যায় এবং আপনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন।

বিদেশ যাত্রার জন্য ‘অভিবাসী ঋণ’: সহজ ও দ্রুত

অনেকে টাকা না থাকার কারণে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে জামানতবিহীন ‘অভিবাসী ঋণ’ পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত এই ঋণ পাওয়া সম্ভব, যা নতুন ও পুনঃপ্রবেশ ভিসা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুদের হার মাত্র ৯ শতাংশ এবং কিস্তিতে ফেরত দিতে হয়। ঋণ নিতে হলে প্রয়োজন হয় ছবি, ভোটার আইডি, পাসপোর্ট, ভিসা, স্মার্ট কার্ড ও একটি জামিনদারের তথ্যসহ কিছু কাগজপত্র।

এই ঋণ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য বিদেশ যাত্রাকে সহজ ও নিরাপদ করে তোলে।

দালাল ফাঁদে পড়বেন না: নিরাপদ অভিবাসনের নিয়মাবলী

বিদেশ যাত্রায় সবচেয়ে বড় বিপদ দালালদের হাত থেকে। তারা মিথ্যা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে প্রতারণা করে। তাই কখনোই অজানা দালালদের বিশ্বাস করবেন না। সরকার অনুমোদিত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে চাকরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। বিএমইটির ওয়েবসাইটে বৈধ এজেন্সির তালিকা পাওয়া যায়। সব আর্থিক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করে রসিদ সংরক্ষণ করা জরুরি।

ভিসা, পাসপোর্ট এবং শ্রম চুক্তিপত্র খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে। সব তথ্য পরিবারের সদস্যদের জানান। সঠিক প্রস্তুতির মাধ্যমে দালালের ফাঁদ এড়িয়ে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রবাস যাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।

গন্তব্য দেশের সঠিক নির্বাচন

বিদেশে যাওয়া আগে গন্তব্য দেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। কোন দেশে যাচ্ছেন, সেখানে কী ধরনের কাজ হবে, বেতন কত, আবাসনের ব্যবস্থা কেমন—এসব তথ্য নিশ্চিত করতে হবে। বিএমইটির ওয়েবসাইট ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অফিস থেকে এসব তথ্য নেওয়া যেতে পারে। জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস থেকেও সরাসরি পরামর্শ নিতে পারেন।

দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি কেমন আচরণ হয়, সেটাও খোঁজ নিতে হবে। কিছু দেশে দালালের দৌরাত্ম্য বেশি, সেসব দেশের প্রতি সতর্ক থাকা ভালো। নিরাপদ অভিবাসনের জন্য গন্তব্য দেশের সরকারিভাবে অনুমোদিত শ্রম বাজার বেছে নিতে হবে।

বিদেশ যাত্রার আগে প্রয়োজনীয় অন্যান্য দক্ষতা ও প্রস্তুতি

  • ভাষাজ্ঞান: গন্তব্য দেশের ভাষা এবং ইংরেজি ভাষায় বেসিক যোগাযোগ জেনে নেওয়া জরুরি। ভাষাগত দক্ষতা কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে এগিয়ে রাখে।
  • প্রশিক্ষণ ও ট্রেড স্কিল: ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, ড্রাইভিং, পরিচ্ছন্নতা, কুকিং ইত্যাদি দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে অবশ্যই সরকারি বা স্বীকৃত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত।
  • সনদপত্র: প্রশিক্ষণের শংসাপত্র থাকলে তা চাকরিদাতার কাছে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় এবং নিজের যোগ্যতা প্রমাণিত হয়।

বিদেশ যাত্রার জন্য আবশ্যকীয় কাগজপত্র ও প্রস্তুতি

বিদেশ যাত্রার আগে নিম্নলিখিত কাগজপত্র ও শর্ত পূরণ নিশ্চিত করতে হবে:

  • বৈধ পাসপোর্ট ও কর্মসংস্থানের ভিসা
  • বিমানের টিকিট
  • নিয়োগপত্র বা শ্রম চুক্তিপত্র
  • মেডিকেল সার্টিফিকেট (যদি প্রযোজ্য হয়)
  • বিএমইটির ছাড়পত্র বা স্মার্ট কার্ড
  • বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তথ্য ও ঠিকানা
  • সবকিছু যাচাই-বাছাই করে স্বাক্ষর করা চুক্তিপত্র
  • বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে সাহায্য নেওয়া

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া অন্য কোনো পথে সমুদ্রপথে বা অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবাসীদের নিরাপদ অভিবাসনের জন্য নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা নিয়মিত সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। তাই আগ্রহী ব্যক্তিদের উচিত এসব সংস্থার সাথে যোগাযোগ রাখা।

বর্তমান বিশ্ববাজারে কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতা দিনদিন বাড়ছে। তাই বিদেশে কাজ পেতে হলে আইনি, আর্থিক, ভাষাগত ও কারিগরি দিক থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হবে। সঠিক তথ্য, বৈধ কাগজপত্র, শক্তিশালী সিভি, দক্ষতা ও সঠিক গন্তব্য নির্বাচন ছাড়া সফল প্রবাস জীবন সম্ভব নয়। দালালের ফাঁদ এড়িয়ে সরকারি অনুমোদিত মাধ্যমেই বিদেশ যাত্রা নিশ্চিত করতে হবে।

নিজেকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করাই সফল প্রবাসীর প্রথম পদক্ষেপ। সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করুন, জীবন বদলের স্বপ্ন সফল করুন।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button