
বহু বছর ধরে চলা আন্তর্জাতিক বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্য। রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) আলাদা আলাদা বিবৃতিতে তিনটি দেশ ঘোষণা দেয় যে, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শুধু প্রতীকী নয়; এটি বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে।
ঘোষণা ও সরকারি বিবৃতি
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এক ভিডিও বার্তায় বলেন,
“আজ আমরা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি। মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।”
একই দিনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জানান,
‘ ফিলিস্তিনের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সম্মান জানাতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,
“এই স্বীকৃতি কেবল একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবিক সংকট মোকাবিলার বাস্তব উদ্যোগ।”
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো পশ্চিমা দেশগুলো এতদিন এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান নিয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, গাজায় চলমান মানবিক সংকট, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ এবং শান্তি আলোচনার ব্যর্থতা পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় অবশেষে একসঙ্গে তিন দেশ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করা।” ইসরায়েলের দাবি, এ ধরনের পদক্ষেপ ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোকে আরও উৎসাহিত করবে এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করবে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের কূটনৈতিক অবস্থান আরও চাপে পড়বে।
ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই স্বীকৃতিকে ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেছে। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, “এটি আমাদের সংগ্রামের ন্যায্য স্বীকৃতি। আমরা আশা করি, বিশ্বের অন্যান্য দেশও দ্রুত এই পথে এগিয়ে আসবে।”
আরব লীগ, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো তিন দেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের মতে, এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতি এক প্রকার বৈশ্বিক স্বীকৃতি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। এর ফলে ইউরোপের আরও কিছু দেশ যেমন ফ্রান্স, পর্তুগাল ও লুক্সেমবার্গও শিগগিরই একই পথে হাঁটতে পারে।
তবে সমালোচকরা সতর্ক করে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত ইসরায়েলকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারে, যা স্বল্পমেয়াদে সংঘাত বাড়াতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
এখন বড় প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে? ওয়াশিংটন এতদিন দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে থাকলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি থেকে বিরত থেকেছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন এবং ইসরায়েলের প্রভাবশালী লবি এই সিদ্ধান্তকে জটিল করে তুলছে। তবে যদি যুক্তরাষ্ট্রও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে এটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের এই স্বীকৃতি নিছক রাজনৈতিক ঘোষণা নয়; বরং এটি ভবিষ্যতের শান্তি আলোচনার ভিত্তি তৈরি করতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ বাড়ছে যেন তারা আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে।
তবে ভবিষ্যৎ পথ মোটেও সহজ নয়। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে গভীর আস্থার সংকট, গাজার চলমান সংঘাত ও রাজনৈতিক বিভাজন শান্তি প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে। তবুও অনেকেই আশাবাদী যে, এই স্বীকৃতি মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির পথে নতুন আলো জ্বালাবে।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক স্থাপন করেছে। এটি শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের বৈধ স্বীকৃতিই নয়, বরং বৈশ্বিক শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার একটি বড় পদক্ষেপ। এখন বিশ্বের চোখ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের দিকে, যারা এই সিদ্ধান্তে পরবর্তী অধ্যায় যোগ করতে পারে।
এম আর এম – ১৪৪৪,Signalbd.com