আঞ্চলিক

ভাঙ্গা মহাসড়ক অবরোধের প্রধান সমন্বয়ক গ্রেপ্তার: ফরিদপুরে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সাম্প্রতিক মহাসড়ক অবরোধকে ঘিরে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। টানা কয়েক দিনের আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম সিদ্দিক মিয়াকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এই গ্রেপ্তার শুধু স্থানীয় রাজনীতিতেই আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন তুলেছে—কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? মহাসড়ক অবরোধের পেছনে আসল কারণ কী? প্রশাসনের পদক্ষেপে জনগণের প্রতিক্রিয়া কেমন?

এই প্রতিবেদনে আমরা পুরো ঘটনার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করব—অবরোধের সূচনা থেকে গ্রেপ্তারের কারণ, প্রশাসনের ভূমিকা, স্থানীয় জনমত এবং ভবিষ্যতে এর সম্ভাব্য প্রভাব পর্যন্ত।

ঘটনার শুরু: নির্বাচনী সীমানা পরিবর্তন নিয়ে ক্ষোভ

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচন কমিশন একটি নতুন গেজেট প্রকাশ করে। তাতে ফরিদপুর-৪ আসনের অধীনে থাকা ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে হঠাৎ করে ফরিদপুর-২ আসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এই সিদ্ধান্ত এলাকাবাসীর কাছে আকস্মিক ও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তারা ফরিদপুর-৪ আসনের অধীনে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। সীমানা পরিবর্তনের ফলে শুধু নির্বাচনী হিসাবই নয়, বরং উন্নয়ন কার্যক্রম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা কার্যক্রমে প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করেন তারা।

ফলস্বরূপ এলাকায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের আন্দোলন শুরু হয়।

মহাসড়ক অবরোধ ও জনভোগান্তি

ভাঙ্গা একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ কেন্দ্র। এখানকার মহাসড়ক রাজধানী ঢাকাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম।

কিন্তু সীমানা পরিবর্তনের প্রতিবাদে টানা কয়েকদিন ধরে এলাকাবাসী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। ফলে—

  • ঢাকামুখী যান চলাচল ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে
  • দূরপাল্লার বাস-ট্রাকসহ জরুরি যানবাহন আটকে যায়
  • সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন
  • ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়

অবরোধ চলতে থাকায় শুধু স্থানীয় মানুষ নয়, পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধাক্কা লাগে।

চেয়ারম্যান ম. ম সিদ্দিক মিয়ার নেতৃত্ব

আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম সিদ্দিক মিয়া

  • তিনি শনিবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, তৃতীয় দফায় সকাল-সন্ধ্যা তিন দিনের টানা অবরোধ পালিত হবে।
  • আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ দাবি করলেও বাস্তবে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।
  • প্রশাসন বারবার সতর্ক করলেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়।

  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়
  • মহাসড়কে মোতায়েন করা হয় এবিসি কামান ও জলকামান
  • ভোর থেকেই প্রায় এক হাজার পুলিশ, র‍্যাব ও সেনা সদস্য মাঠে নামে
  • চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ভাঙ্গা সার্কেল) আসিফ ইকবাল বলেন—
“জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। কোনো নাশকতা হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

গ্রেপ্তার অভিযান

শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বিশেষ অভিযান চালিয়ে চেয়ারম্যান সিদ্দিক মিয়াকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে।

ভাঙ্গা থানার ওসি আশরাফ হোসেন বলেন—
“সিদ্দিক মিয়াকে ডিবি পুলিশ আটক করেছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।”

স্থানীয় জনমত ও প্রতিক্রিয়া

গ্রেপ্তারের পর এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

  • আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রশাসন গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করছে।
  • অন্যদিকে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, অবরোধের কারণে তাদের চরম ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে।
  • রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করলে এ ধরনের আন্দোলন আরও ছড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞ মতামত

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান বলেন—
“বাংলাদেশে নির্বাচনী সীমানা পরিবর্তন নতুন বিষয় নয়। তবে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ভাঙ্গার ঘটনায়ও তাই হয়েছে।”

আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার নাহিদা আক্তার বলেন—
“যদি কোনো সিদ্ধান্তে জনগণের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে আন্দোলনের অধিকার তাদের আছে। কিন্তু অবরোধ বা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা আইনগতভাবে অপরাধ।”

সম্ভাব্য প্রভাব

এই ঘটনার ফলে ভাঙ্গা ও আশপাশের এলাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।

  • সিদ্দিক মিয়ার গ্রেপ্তার আন্দোলনকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করতে পারে
  • প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকায় পরিস্থিতি সংঘর্ষের দিকে গড়াতে পারে
  • নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি আরও জোরদার হতে পারে

ভাঙ্গার মহাসড়ক অবরোধ ও সমন্বয়ক গ্রেপ্তারের ঘটনা শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। জনগণ আশা করছে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন দ্রুত একটি সমাধান বের করবে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারও সংরক্ষিত হয়।

MAH – 12797  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button