দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক যুগের দীর্ঘ অপেক্ষার পর নতুন প্রাপ্তি। ১৬ বছরের বিরতির পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করা হচ্ছে। পাশাপাশি, প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ২০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মিড-ডে মিল কার্যক্রম শুরু করা হবে। এ ঘোষণা করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই তথ্য জানান। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন উদ্যোগ
বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার জানান, “প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং শিক্ষকের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বৃত্তি পরীক্ষা চালু করা হচ্ছে। এটি শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষা মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে বছরে মাত্র ১৮০ দিন ক্লাস হয়। তবে, শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকরা শিক্ষা ব্যতিরেকে অন্যান্য সরকারি ও প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষা ক্যালেন্ডারে ছুটি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
মিড-ডে মিল কর্মসূচি
প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে মিড-ডে মিল কর্মসূচি চালু করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ২০০টি বিদ্যালয়ে এই কর্মসূচি সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে কার্যকর হবে।
বিধান রঞ্জন বলেন, “শিশুদের পুষ্টি ও সুস্থতা নিশ্চিত করা শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। মিড-ডে মিলের মাধ্যমে শিশুদের খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর পাশাপাশি বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষার মানও উন্নত হবে।”
শিক্ষকের পদোন্নতি ও কর্মসংস্থান
শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জটিলতা বিদ্যমান। অনেক শিক্ষক আদালতের মামলার কারণে পদোন্নতি পাননি। গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন জানান, বর্তমানে প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষক প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষমান রয়েছেন।
তিনি বলেন, “পদোন্নতি দেওয়ার পর নতুন পদ সৃষ্টি হবে, যা শিক্ষকদের কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিক্ষকরা আরও উৎসাহিত হবেন এবং শিক্ষার্থীর শিক্ষার মানও বৃদ্ধি পাবে।”
দেশের সাক্ষরতার বর্তমান অবস্থা
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার ৭৭.৯ শতাংশ। কিন্তু এখনও ২২.১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। এই সংখ্যা শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
বিধান রঞ্জন বলেন, “যারা কখনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি অথবা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা ছেড়ে গেছে, তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এটি দেশের শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
প্রাথমিক শিক্ষায় পুনর্বিবেচনার গুরুত্ব
বিগত কয়েক বছরে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য নতুন নীতি গ্রহণ, শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং বিদ্যালয় পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
বৃত্তি পরীক্ষার পুনঃপ্রবর্তন শিক্ষার্থীর শিক্ষার অগ্রগতিকে মূল্যায়ন করার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও তাদের শিক্ষাদানের দক্ষতা যাচাই করার সুযোগ দেবে।
আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবসের প্রেক্ষাপট
রোববার অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলন আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে। এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো দেশের সকল স্তরে শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা এবং নাগরিকদের মধ্যে সাক্ষরতার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন বলেন, “শিক্ষা শুধু পাঠ্যবই পড়ার বিষয় নয়, এটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। সাক্ষরতার হার বাড়ানো আমাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য।”
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রত্যাশা
নতুন সিদ্ধান্তগুলো শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। প্রাথমিক শিক্ষায়:
- বৃত্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মৌলিক জ্ঞান যাচাই
- মিড-ডে মিলের মাধ্যমে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত
- শিক্ষকের পদোন্নতি ও কর্মসংস্থানের সৃজন
- ছুটির দিনের পুনর্বিন্যাস ও কার্যকর শিক্ষা ক্যালেন্ডার
- নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি
এই উদ্যোগগুলো শিক্ষাব্যবস্থার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষা হলো দেশের শিক্ষার ভিত্তি। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নত হয়, তবে মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার মানও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে।
বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার জানান, “আমরা চাই দেশের প্রতিটি শিশু প্রাথমিক পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করুক। এটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।”
১৬ বছরের বিরতির পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু এবং মিড-ডে মিল কার্যক্রম শুরু দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। শিক্ষার্থীর মান উন্নয়ন, শিক্ষকের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি এবং দেশের সার্বিক সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আশা করা যায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।
MAH – 12678, Signalbd.com



