ঈদযাত্রায় যমুনা সেতুতে রেকর্ড টোল আদায়: ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৩ কোটি টাকা

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশের অন্যতম ব্যস্ত মহাসড়ক ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এরই মধ্যে যমুনা বহুমুখী সেতুতে একদিনেই টোল আদায়ে রেকর্ড গড়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। গেল ২৪ ঘণ্টায় এই সেতু দিয়ে পারাপার হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৬৪টি যানবাহন, যার বিপরীতে আদায় হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকা।
এই বিপুল পরিমাণ টোল আদায় সেতুর ইতিহাসে ঈদযাত্রা উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য এক অর্থনৈতিক প্রবাহ নির্দেশ করে। যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষ আশা করছে, আসন্ন ঈদে যাত্রীচাপ আরও বাড়বে এবং পরবর্তী কয়েকদিনে টোল আদায়ের পরিমাণ নতুন রেকর্ড ছুঁতে পারে।
কর্তৃপক্ষের তথ্য ও বিশ্লেষণ
আজ বুধবার (৪ জুন) সকালে যমুনা সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল গণমাধ্যমকে জানান,
“গত সোমবার রাত ১২টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩৩ হাজার ৫৬৪টি যানবাহন পার হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গগামী ছিল ১৭ হাজার ৫৬৭টি এবং ঢাকাগামী ছিল ১৫ হাজার ৯০৭টি।”
উত্তরবঙ্গগামী যানবাহন থেকে আদায় হয়েছে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৮২ হাজার ৮৫০ টাকা এবং ঢাকামুখী যানবাহন থেকে আদায় হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার ৫০ টাকা।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, এবার ঈদের আগাম ছুটি ও কর্মস্থল ছাড়ার আগ্রহের কারণে তুলনামূলকভাবে আগে থেকেই যাত্রা শুরু করেছেন মানুষ। ফলে সড়কে গাড়ির চাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত বছর এই সময়ে সেতুতে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ছিল গড়ে ২৫ থেকে ২৮ হাজারের মধ্যে, তবে এবার তা ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে।
যানজট পরিস্থিতি ও মহাসড়কের অবস্থা
ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের ২২টি জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে যমুনা সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি ঈদ মৌসুমে যমুনা সেতু মহাসড়ককে ঘিরে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক এবং পিকআপ ভ্যানের চাপ বাড়ে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্তে এলেঙ্গা, কালিহাতী, গোড়াই, গাজীপুরের চন্দ্রা চৌরাস্তা ও শিমুলতলী পর্যন্ত কোথাও কোথাও গাড়ির গতি ছিল ধীর। তবে সেতুর টোল প্লাজায় অতিরিক্ত বুথ চালু ও ম্যানুয়াল ব্যবস্থায় দক্ষ কর্মী নিয়োগের ফলে যানজট এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
যাত্রীদের ভোগান্তি এবং প্রতিক্রিয়া
যাত্রীদের অনেকেই জানিয়েছেন, অতীতে ঈদযাত্রায় সেতুর পূর্বপ্রান্তে দীর্ঘ যানজট ও অপেক্ষার ভোগান্তিতে পড়তে হতো। এবার কিছুটা শৃঙ্খলা থাকলেও ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ধীরগতিতে চলেছে যানবাহন।
সিরাজগঞ্জগামী এক যাত্রী বলেন,
“ঢাকা থেকে রাত ২টায় রওনা দিয়ে সকাল ৮টায় সেতু পার হয়েছি। ভোরে গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত গাড়ি একবারে থেমে থেমে চলেছে। তবে এবার আগের চেয়ে পরিস্থিতি ভালো।”
অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও রাষ্ট্রীয় রাজস্ব
যমুনা সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার যানবাহন চলাচল করে। ঈদ বা জাতীয় কোনো উৎসবে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজারের ওপরে। প্রতি যানবাহনের ধরন অনুযায়ী টোল নির্ধারিত হলেও গড়ে প্রতিটি যানবাহনের মাধ্যমে ৮০০–৯০০ টাকা পর্যন্ত টোল আদায় হয়।
২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৩ কোটি টাকার কাছাকাছি রাজস্ব আয় শুধু যমুনা সেতু থেকেই জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের শিল্পপণ্য, কাঁচামাল, কৃষিপণ্য ও যাত্রী পরিবহনের বড় মাধ্যম হিসেবে যমুনা সেতু একটি প্রধান অর্থনৈতিক লাইফলাইন।
টোল আদায়ে নতুন প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা
যমুনা সেতুতে বর্তমানে ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ETC) পদ্ধতির পাশাপাশি ম্যানুয়াল পদ্ধতিও চালু আছে। তবে ঈদের মতো চরম ব্যস্ত সময়ে শুধু ইটিসি প্রযুক্তি পুরো চাপ সামাল দিতে পারছে না। তাই অতিরিক্ত জনবল ও মোবাইল বুথের মাধ্যমে আদায় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ ডিজিটাল টোল কালেকশন এবং স্বয়ংক্রিয় লাইসেন্স স্ক্যানিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে যানবাহন আটকে না থেকে চলার গতি বজায় থাকবে এবং টোল আদায়ে স্বচ্ছতা আসবে।
ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ও পুলিশের প্রস্তুতি
যানজট এড়াতে টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগ যৌথভাবে কাজ করছে। বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ টিম নিয়োজিত রয়েছে এবং হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে।
এলেঙ্গা, ভূঞাপুর, কালিহাতী, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন,
“চেষ্টা করছি গাড়িগুলো যেন টোল প্লাজা পর্যন্ত সহজে পৌঁছায় এবং গাড়ির লেন ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।”
ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশ ও পরিকল্পনা
অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং যানচলাচলের গতি ঠিক রাখতে যমুনা সেতুর সমান্তরালে ‘যমুনা সেতু দ্বিতীয় পর্ব’ বা ডুয়েল ক্যারেজওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
ঈদের আগাম প্রস্তুতি ও সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনার ফলে যমুনা সেতু দিয়ে একদিনে প্রায় ৩ কোটি টাকার টোল আদায় জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক ইতিবাচক দিক। এটি যেমন রাজস্ব প্রবাহে ভূমিকা রাখছে, তেমনি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের গতিশীলতাও নিশ্চিত করছে। পরবর্তী দিনগুলোতে সেতু কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বয় আরও বাড়লে যাত্রীদের ভোগান্তি অনেকটাই হ্রাস পাবে—এমনটাই প্রত্যাশা।