গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে ৯৪০টি অস্ত্রের চালান

অস্ত্রের পাহাড় পাচ্ছে ইসরায়েল, যুদ্ধবিরতি উপেক্ষায় উদ্বেগ আন্তর্জাতিক মহলে
গাজা উপত্যকায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের বর্বর সামরিক আগ্রাসন চলমান। এই আগ্রাসনের সময় থেকে আজ অবধি ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছে ৯৪০টির বেশি অস্ত্রের চালান। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদুলু এজেন্সি, কাতারভিত্তিক আল জাজিরা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার (২৭ মে ২০২৫) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা অস্ত্রবাহী ৮০০তম সামরিক ফ্লাইট ইসরায়েলে পৌঁছেছে। এ ছাড়া, সমুদ্রপথে জাহাজে করে আরও ১৪০টি চালান পাঠানো হয়েছে।
কি ছিল এই অস্ত্র চালানগুলোতে?
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই চালানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ভারী গোলাবারুদ
- সাঁজোয়া যান (armored vehicles)
- ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (বডি আর্মার, হেলমেট ইত্যাদি)
- সামরিক চিকিৎসা সরঞ্জাম
ইসরায়েল দাবি করেছে, এখন পর্যন্ত তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯০ হাজার টনের বেশি সামরিক সরঞ্জাম পেয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলে একক বৃহত্তম অস্ত্র সহায়তা।
গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে
অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের একটি আকস্মিক অভিযানের জবাবে ইসরায়েল গাজায় আগ্রাসন শুরু করে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ছিল অপ্রত্যাশিত। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেও এই আগ্রাসনকে “অসামান্য মাত্রায় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই শিশু ও নারী। প্রায় ১৮ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র—সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আহ্বানে কর্ণপাত করেনি ইসরায়েল
এ পর্যন্ত ৭ বার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু মার্কিন ভেটোর কারণে তা পাস হয়নি। এর ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইউএনএইচসিআর এই সংঘর্ষে ইসরায়েলের কার্যকলাপকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা ও সমালোচনার ঝড়
বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা এবং যুদ্ধবিরতির পক্ষে কথা বললেও বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ তার বিপরীত। ইসরায়েলের প্রতি এমন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সহায়তা প্রদান যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সম্মান জানানোই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “আত্মরক্ষা” নামের মোড়কে ইসরায়েলের এই সহিংসতা বৈধতা পাচ্ছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও ভিন্নমত
ইসরায়েলের ভেতরেও অনেক মানবিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ গাজায় হামলা বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন। তবে সরকার ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কড়া অবস্থানের কারণে এই দাবিগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ড. সামির ফারুক বলেন,
“এত বিপুল অস্ত্র সহায়তা সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থামানোর বদলে যেন আগুনে ঘি ঢালছে।”
অন্যদিকে তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেহমেত এলিস দাবি করেন,
“যুক্তরাষ্ট্র এভাবে অস্ত্র পাঠিয়ে কেবল ইসরায়েলকে নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা জিইয়ে রাখছে।”
আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া
মিশর, জর্ডান, কাতার, তুরস্কসহ বহু আরব দেশ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছে। এমনকি সৌদি আরবও যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা একাধিকবার জাতিসংঘে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও হত্যা ‘জঘন্য অপরাধ’। বাংলাদেশ জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা পাঠানো অব্যাহত রেখেছে।
পরিণতি কী হতে পারে?
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি এই আগ্রাসন চলতে থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না হয়, তাহলে গাজা শুধু নয়, পুরো অঞ্চলে আরও বড় সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে। ইরান, হিজবুল্লাহ, এমনকি লেবানন ইতোমধ্যে সতর্ক বার্তা দিয়েছে।