নোয়াখালীর হাতিয়ায় ধরা পড়লো ২৮ কেজির দৈত্যাকৃতির কোরাল মাছ
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মেঘনা নদীতে এক জেলের জালে ধরা পড়েছে বিরল আকারের এক বিশাল কোরাল মাছ। মাছটির ওজন প্রায় ২৮ কেজি (সঠিকভাবে ২৭ কেজি ৭০০ গ্রাম)। শনিবার (১৬ আগস্ট ২০২৫) সকালে উপজেলার নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের নামার বাজারে অবস্থিত ইব্রাহিম মৎস্য আড়তে মাছটির নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। নিলামে মাছটি ৪১ হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়, যা গড়ে প্রতি কেজি প্রায় ১,৫০০ টাকার মতো।
জেলে রাশেদের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাছটি ধরা পড়ে নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের জেলে মো. রাশেদ মাঝির জালে। শুক্রবার রাতে তিনি মেঘনা নদীতে জাল ফেলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশাল আকারের কোরাল মাছটি ধরা পড়ে। সকালে রাশেদ মাছটি নিয়ে যান নামার বাজারের ইব্রাহিম মৎস্য আড়তে।
আড়তের নিলামে বিএনপি নেতা ও মাছ ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম মাছটি কিনে নেন। বিক্রির পর রাশেদ মাঝি জানান, জীবনে তিনি এর আগে এত বড় কোরাল মাছ কখনো পাননি। এই মাছটি তার জীবনের একটি বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে।
হাতিয়ার বাজারে বিরল দৃশ্য
নিলামে উপস্থিত এলাকাবাসী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এত বড় কোরাল মাছ সচরাচর মেঘনায় ধরা পড়ে না। বাজারে এমন মাছ উঠলে মানুষ ভিড় করে দেখতে আসে। শনিবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সকাল থেকে খবর ছড়িয়ে পড়লে নামার বাজারে ভিড় জমে যায়। অনেকেই মোবাইলে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করেন।
কেন এত দামে বিক্রি হয় কোরাল মাছ?
বাংলাদেশে কোরাল মাছ একটি উচ্চমূল্যের সামুদ্রিক মাছ। এর স্বাদ ও গুণগত মান অত্যন্ত ভালো। সাধারণত হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও রপ্তানিকারকদের কাছে বড় আকারের কোরালের চাহিদা বেশি থাকে।
একজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, “কোরাল মাছের দাম সবসময়ই বেশি থাকে। তবে ২০ কেজির বেশি হলে বাজারমূল্য আরও বাড়ে। কারণ এ ধরনের মাছ বিরল এবং সবার নাগালের বাইরে। বড় কোরালের মাংস তুলনামূলক নরম ও সুস্বাদু হয়, তাই এর দাম দ্রুত বেড়ে যায়।”
ইব্রাহিমের বক্তব্য
মাছটি কিনে নেওয়া মো. ইব্রাহিম বলেন, “আমি এর আগে হাতিয়ায় বড় কোরাল মাছ কিনেছি, তবে এ বছর এইটিই সবচেয়ে বড়। এত বড় মাছ সচরাচর পাওয়া যায় না। আমি আশা করছি মাছটি ভালো দামে বিক্রি করতে পারব।”
মৎস্য কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া
হাতিয়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফাহাদ হাসান বলেন, “হাতিয়া উপজেলা ও নিঝুমদ্বীপ চারদিকে নদী পরিবেষ্টিত হওয়ায় এখানে নিয়মিতভাবেই বড় মাছ পাওয়া যায়। তবে সরকার যে মৎস্য সংরক্ষণ কর্মসূচি নিয়েছে, তার প্রভাবেই নদীতে বড় আকারের মাছের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী দিনে জেলেরা আরও বেশি বড় মাছ ধরতে পারবেন বলে আমরা আশাবাদী।”
তিনি আরও বলেন, “মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার জেলেদের জন্য নানা সময় ভিজিএফ চাল, নগদ সহায়তা এবং জাটকা নিধন বন্ধে কঠোর অভিযান চালায়। ফলে নদীর পরিবেশ ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হচ্ছে।”
বাংলাদেশে কোরাল মাছের বাজার
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে—বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, বরিশাল ও নোয়াখালী অঞ্চলে কোরাল মাছ ধরা পড়ে। তবে বড় কোরালের দেখা পাওয়া এখন তুলনামূলক কমে গেছে।
বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী,
- ১০–১৫ কেজির কোরাল মাছ সাধারণত ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকায় বিক্রি হয়।
- ২০–২৫ কেজির কোরাল মাছ ৩০,০০০ থেকে ৩৮,০০০ টাকা পর্যন্ত দাম পায়।
- ২৫ কেজির বেশি হলে দাম ৪০,০০০ টাকার উপরে চলে যায়।
কোরাল মাছের পুষ্টিগুণ
কোরাল মাছ শুধু স্বাদে নয়, পুষ্টিতেও সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ডি, ওমেগা–৩ ফ্যাটি এসিড, আয়রন ও ক্যালসিয়াম থাকে। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, হাড় মজবুত করতে এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা উন্নত করতে সহায়ক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত কোরাল মাছ খেলে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে। এছাড়া শিশুদের বৃদ্ধি ও বয়স্কদের পুষ্টি ঘাটতি পূরণে এটি কার্যকর।
মেঘনার জেলেদের ভাগ্যের গল্প
হাতিয়া ও নিঝুমদ্বীপের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সরাসরি মৎস্যশিকার বা মাছ-সম্পর্কিত পেশার সঙ্গে জড়িত। এই অঞ্চলের মানুষ নদীর ওপরই নির্ভরশীল। বড় কোনো মাছ ধরা পড়লে সেটি শুধু জেলের নয়, পুরো এলাকার জন্যই আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
স্থানীয়রা বলেন, “যখন কোনো বড় মাছ ওঠে, তখন বাজারে উৎসবের মতো পরিবেশ তৈরি হয়। অনেকে শুধু দেখতেই আসে, কেনার সামর্থ্য না থাকলেও ছবি তুলে আনন্দ করে।”
বড় কোরাল মাছ ধরা পড়ার নজির
বাংলাদেশে এর আগে আরও কয়েকবার বিশাল আকারের কোরাল মাছ ধরা পড়েছে।
- ২০২৩ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ৩২ কেজি ওজনের কোরাল মাছ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
- ২০২৪ সালে ভোলায় ২৬ কেজি কোরাল মাছ ধরা পড়ে, দাম উঠেছিল প্রায় ৪৫ হাজার টাকা।
- এ বছর হাতিয়ায় ২৮ কেজি কোরাল পাওয়া গেল, যা এলাকার মানুষের কাছে বিরল আনন্দের খবর।
নোয়াখালীর হাতিয়ায় মেঘনা নদীতে ধরা পড়া ২৮ কেজির বিশাল কোরাল মাছের ঘটনা শুধু স্থানীয় জেলেদের জন্য নয়, সারা বাংলাদেশের মাছপ্রেমীদের কাছেও আনন্দের খবর। এই ধরনের মাছ ধরা পড়া প্রমাণ করে যে নদীর পরিবেশ ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
মাছটির নিলামমূল্য ৪১ হাজার ৫৫০ টাকা হলেও, এর পেছনে লুকিয়ে আছে জেলেদের আশা, পরিশ্রম এবং জীবিকার গল্প। কোরাল মাছ বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্পদের এক অমূল্য দৃষ্টান্ত, যা আমাদের নদী ও সমুদ্র জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধির প্রতীক।
MAH – 12339 , Signalbd.com



