বিশ্ব

মার্কিন ড্রোন হামলায় ইয়েমেনে আল-কায়েদার পাঁচ নেতা নিহত।

ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত এক ড্রোন হামলায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার পাঁচ সদস্য নিহত হয়েছেন। এই অভিযানে নিহতদের মধ্যে সংগঠনের একজন স্থানীয় শীর্ষ নেতা থাকতে পারেন বলে ধারণা করছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। গত শুক্রবার এই হামলা চালানো হয় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি।

হামলার স্থান: খাবার আল-মারাকশা, আবিয়ান প্রদেশ

নিরাপত্তা সূত্র জানায়, এই হামলাটি ইয়েমেনের আবিয়ান প্রদেশের খাবার আল-মারাকশা নামক পাহাড়ি অঞ্চলে চালানো হয়। এলাকাটি আল-কায়েদার গোপন ঘাঁটি ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত। মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যে ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে এই হামলা চালানো হয়।

প্রদেশটির এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

“স্থানীয়রা বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর আমাদের জানায়। পরে সেখানে পৌঁছে আমরা আল-কায়েদার পাঁচ সদস্যের মৃতদেহ উদ্ধার করি।”

তিনি আরও জানান, নিহতদের মধ্যে একজন সম্ভবত আল-কায়েদার স্থানীয় অপারেশন কমান্ডার ছিলেন। নিহতদের পরিচয় এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে গোয়েন্দা বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট যে তারা সক্রিয় জঙ্গি সদস্য ছিলেন।

আল-কায়েদা ইন দ্য অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (AQAP): এক নজরে

এই সংগঠনটি ২০০৯ সালে ইয়েমেন ও সৌদি আরবের আল-কায়েদা শাখা একত্রিত হয়ে গঠন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই এ গোষ্ঠীকে সবচেয়ে বিপজ্জনক আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। তারা শুধুমাত্র ইয়েমেনে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও হামলার পরিকল্পনায় জড়িত ছিল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,

“AQAP শুধুমাত্র স্থানীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের অন্যতম মূল চালিকা শক্তি।”

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল

যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে। এসব হামলায় শীর্ষস্থানীয় অনেক জঙ্গি নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এ ধরনের হামলায় বেসামরিক হতাহতের আশঙ্কাও থেকেছে, যে কারণে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা রয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য অনুযায়ী,

“এই ধরনের লক্ষ্যভিত্তিক হামলা AQAP-এর শক্তি খর্ব করতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে।”

ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ এবং জঙ্গি বিস্তার

২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধ আল-কায়েদার বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সামরিক অভিযানে দেশটিতে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আল-কায়েদা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বাড়িয়েছে।

বিশেষ করে দক্ষিণ ইয়েমেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা নিরাপদ ঘাঁটি গড়ে তোলে এবং স্থানীয় দুর্বল প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি ও মার্কিন নীতির পরিবর্তন

২০২৫ সালের মে মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে। এতে সাময়িকভাবে ইয়েমেনের বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলমান মার্কিন ড্রোন হামলা বন্ধ হয়। তবে আল-কায়েদার মতো গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরত হয়নি।

একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে,

“হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হলেও, যুক্তরাষ্ট্র এখনো AQAP ও আইএসের মতো সংগঠনের বিরুদ্ধে আগের মতোই কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণ

এই হামলার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো এই হামলাকে জঙ্গি দমনে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে, তবে কিছু মানবাধিকার সংগঠন বেসামরিক প্রাণহানির আশঙ্কা ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তুলে ধরা শুরু করেছে।

জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন,

“যদিও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গুরুত্বপূর্ণ, তবুও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী এর সঠিকতা ও জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ড্রোন হামলা আবারও ইয়েমেনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের গুরুত্ব সামনে নিয়ে এসেছে। ইয়েমেনে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা, ভঙ্গুর প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর জড়িত থাকার কারণে এই অঞ্চল এখনও জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য উপযোগী ক্ষেত্র হয়ে আছে। যতদিন না ইয়েমেনে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন এই ধরনের হামলা ও সংঘাত চলতেই থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button