বানিজ্য

গাজীপুরে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগে লোটো বাংলাদেশের নতুন জুতা কারখানা

বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়া নির্ভর পণ্যের শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পথে লোটো বাংলাদেশ। দেড় যুগ আগে টঙ্গীর ছোট্ট কারখানায় মাত্র ১৫ লাখ টাকা পুঁজি ও ৩৫ জন কর্মীর পাশাপাশি যাত্রা শুরু করা এই স্বদেশী ব্র্যান্ড, আজ প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় নতুন শিল্প পার্ক গড়ে তুলছে। নতুন কারখানা চালু হলে এক হাজার জনের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে; পাশাপাশি পাঁচ বছরের মধ্যে আয় দেবে ৮০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা।

গতকাল (১৮ মে) কাপাসিয়ার আমরাইদ বাজার সংলগ্ন ২৫ বিঘা জমিতে শিল্প পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এক্সপ্রেস লেদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জামিল ইসলাম, সহযোজনায় ছিলেন কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের সিইও নাজিত মিওয়ানা, ব্র্যাক ব্যাংকের এএমডি তারেক রেফাত উল্লাহ খান, প্রাইম ব্যাংকের এএমডি ফয়সাল রহমান, গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার জাবের সাদিক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।

“টাকার ভালো মান ও সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ রক্ষা করার জন্য স্থিতিশীল সরকার জরুরি। নীতি-সাহায্য পেলে আমরা রপ্তানিমুখী উদ্ভাবনে আরও এগিয়ে যেতে পারব,”–উল্লেখ করেন এমডি কাজী জামিল ইসলাম।

১. দেড় যুগের পথচলা: ছোট্ট কারখানা থেকে শিল্প পার্ক

২০০৭ সালে টঙ্গীর ১০ হাজার বর্গফুট জমিতে পুঁজি ১৫ লাখ টাকা ও ৩৫ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এক্সপ্রেস লেদার প্রোডাক্টস, সাধারণ নাম “লোটো বাংলাদেশ”। প্রথম দিকে সাবকন্ট্রাকটিং ভিত্তিতে বিদেশি ব্র্যান্ডের জন্য জুতা তৈরি করলেও, ২০১১ সালে ইতালির লোটো ব্র্যান্ডের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত উৎপাদন শুরু হয়। ২০১৯ সাল থেকে ব্রিটিশ লি-কুপারের পোশাক, ব্যাগ ও ফুটওয়্যার তৈরিতে অভিজ্ঞতা লাভ ও নিজস্ব পোশাক ব্র্যান্ড ‘দ্য এক্সপ্রেস’ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আজ প্রতিষ্ঠানটি ৯০ হাজার বর্গফুট ফ্যাক্টরিতে দুই হাজার কর্মীর সহযোগিতায় প্রতি মাসে ৮ লক্ষ জোড়া জুতা, স্যান্ডেল ও স্লিপার উৎপাদন করছে।

২. নতুন কারখানা: আধুনিক প্রযুক্তি, বিস্তৃত উৎপাদন লাইন

নতুন ২৫ বিঘা শিল্প পার্ক-এ নির্মিতব্য কারখানায় থাকবে:

  1. জুতা উৎপাদন লাইন: উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন, অটোমেটেড কাটিং ও স্টিচিং ইউনিট
  2. তৈরি পোশাক ইউনিট: ওয়্যারহাউস থেকে শুরু করে ফিনিশিং লাইন পর্যন্ত আধুনিক উপকরণ
  3. অ্যাকসেসরিজ ফ্যাক্টরি: ব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্ট, ইনসোল, মোজার সহ বিভিন্ন শূ ক্যাটাগরি

“প্রজেক্টের প্রথম ধাপে ৬০% নির্মাণ শেষে উৎপাদন শুরু হবে, পরবর্তী দু’বছরে পূর্ণতা পাবে,”–জানা গেছে কোম্পানির একথা।

চীনের জুতা প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি সেবা ও যৌথ বিনিয়োগে অংশ নিচ্ছে, যা উৎপাদন দক্ষতা ও গুণগত মান আরও বাড়াবে।

৩. অর্থনৈতিক প্রভাব: কর্মসংস্থান ও আয়ের বিশ্লেষণ

  • বার্ষিক আয়: বর্তমানে ৩০০ কোটি টাকার বেশি
  • নিউজ উত্থান: নতুন কারখানা চালু হলে আয় ৮০০ কোটি ছাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা
  • কর্মসংস্থান: নতুন পর্যায়ে ১,০০০ জন স্থায়ী কর্মী নিয়োগ
  • মার্কেট পার্ট: বছর শেষে কাপাসিয়ায় উৎপাদিত পণ্যের ২০% অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাবে

“কারখানা চালু হলেই গ্রামীন এলাকায় শৃঙ্খলিত কর্মসংস্থানের ধারা ত্বরান্বিত হবে,”–মত প্রকাশ করেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক।

৪. দেশীয় ও বৈশ্বিক বাজার: সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ

দেশে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকার জুতার বাজার, যার ৩০–৪০% আসে ব্র্যান্ডড পণ্যে। রাজধানী উত্তরায় ২০১২ সালে প্রথম আউটলেট খোলার পর আজ ২২০ শোরুম–ফ্র্যাঞ্চাইজি–ডিলার নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে আরও ২০০ শোরুম, ২০০ ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং ৫০০০ সরবরাহকারী সংযোগের পরিকল্পনা রয়েছে।

রপ্তানিতে ইতিমধ্যে ইতালি, স্পেনসহ কয়েকটি দেশে সীমিত চালু হয়েছে পণ্য; বার্ষিক ১১১ কোটি ডলার জুতা রপ্তানির রেকর্ড ধরে।

৫. সরকারি নীতি ও খাতের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে লেদার ও ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি সরকারী অগ্রাধিকার পেয়েছে। বাংলাদেশ লেদার ইনস্টিটিউট, বেসরকারি বিনিয়োগ নীতি, ট্যাক্স ইনসেনটিভবিনিময় সুবিধা–ই হুমড়ি খেয়ে এগোচ্ছে সেক্টর।

“নতুন শিল্প পার্ক উদ্ভাবনী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠা করবে, যা দেশের বার্ষিক জুতা রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ২০০ কোটি ডলার পার করতে সহায়ক,”–বিশ্লেষক মত।

তবে তালি ও চামড়া মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট, জাতীয় খাটো কর্মির অভাবপরিবেশগত নিয়মনীতি চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ এবং নীতি সহায়তা অপরিহার্য।

৬. ভবিষ্যতের রূপায়ণ: প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন

  • ডিজিটাল ট্র্যাকিং: প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন মনিটরিং
  • টেকসই উপকরণ: বায়োডিগ্রেডেবল ইনসোল, পরিবেশবান্ধব চামড়া
  • বৈশ্বিক মান: ISO সনদসহ আন্তর্জাতিক রপ্তানিমূলক মানদণ্ড অর্জন
  • শিক্ষা–প্রশিক্ষণ: স্থানীয় যুবশক্তিকে দক্ষতা দিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন

“প্রযুক্তি ও টেকসই উপকরণে বিনিয়োগ দেশের খাতকে আরও সবুজ করবে,”–মতো জানান খাতের প্রবীণ উপদেষ্টা।

লোটো বাংলাদেশের ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের এই উদ্যোগ শুধু কারখানা সম্প্রসারণ নয়; এটি দেশের চামড়া ও ফুটওয়্যার শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উত্তরণের সোপান। নতুন কারখানা চালু হলে কর্মসংস্থান, রপ্তানি, উৎপাদন দক্ষতাঅভ্যন্তরীণ বাজার—সবক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হবে।

সরকারি সহায়তা, আধুনিক প্রযুক্তি, শক্তিশালী শ্রমশক্তি ও নীতি সহায়তার সমন্বয়ে বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে লোটো বাংলাদেশের এই বিনিয়োগ মাইলফলক হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button