ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাত বন্ধ করতে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) হোয়াইট হাউস থেকে এক বিশেষ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই পরিকল্পনায় ২০ দফার সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, যা মানা হলে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সঙ্গে সঙ্গে স্থগিত হতে পারে।
উল্লেখ্য, চলমান সংঘাতে এ পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অবকাঠামো, ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা সবই ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি উভয় পক্ষ—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস—এই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করে, তবে যুদ্ধ মুহূর্তেই থেমে যাবে। পরিকল্পনায় গাজার সকল জীবিত ও মৃত জিম্মি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনি বন্দীদেরও মুক্তি দেওয়া হবে।
হোয়াইট হাউসের বৈঠক ও যৌথ সংবাদ সম্মেলন
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অংশ নেন। নেতানিয়াহু এই পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন, তবে হামাসের কর্মকর্তারা এখনো কোনো লিখিত শান্তি প্রস্তাব হাতে পাননি।
ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার মূল বিষয়াবলি
১. সন্ত্রাসমুক্ত গাজা
গাজা হবে একটি উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত অঞ্চল। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি কোনো হুমকি সৃষ্টি করবে না।
২. পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তা
গাজার ধ্বংসস্তূপ পুনর্গঠনের মাধ্যমে জনগণকে দ্রুত পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হবে। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ও সড়ক ব্যবস্থা দ্রুত সংস্কার করা হবে।
৩. যুদ্ধবিরতি ও সীমারক্ষা
যদি উভয় পক্ষ প্রস্তাব গ্রহণ করে, যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হবে। ইসরায়েলি বাহিনী নির্ধারিত সীমারেখায় সরে যাবে, এবং সমস্ত বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ স্থগিত থাকবে।
৪. জিম্মি মুক্তি
ইসরায়েল ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সকল জীবিত ও মৃত জিম্মি ফিরিয়ে দেবে। এছাড়া ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর আটক ১,৭০০ গাজাবাসীও মুক্তি পাবে।
৫. বন্দী মুক্তি ও প্রতিস্থাপন
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দী ছাড়াও নারী ও শিশুদের মুক্তি দেওয়া হবে। প্রতি ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহের বিনিময়ে ১৫ জন গাজাবাসীর মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে।
৬. হামাস সদস্যদের ক্ষমা
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মেনে অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি হামাস সদস্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে। যারা গাজা ত্যাগ করতে চায়, তাদের নিরাপদে অন্য দেশে প্রেরণ করা হবে।
৭. মানবিক সহায়তা প্রবেশ
গাজায় পুরোপুরি মানবিক সহায়তা প্রবেশ করা হবে। হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পানির সিস্টেম, বিদ্যুৎ, বেকারি ও রাস্তা সংস্কার করা হবে।
৮. আন্তর্জাতিক সহায়তা
জাতিসংঘ, রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা বিতরণ করবে। রাফাহ সীমান্ত পুরোনো চুক্তির মতো খোলা ও বন্ধ হবে।
৯. টেকনোক্র্যাট প্রশাসন
গাজার প্রশাসন সাময়িকভাবে একটি ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট কমিটির হাতে থাকবে। এটি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হবে এবং দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করবে। আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা ‘বোর্ড অব পিস’ গঠিত হবে, যার প্রধান থাকবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
১০. অর্থনৈতিক পুনর্গঠন
মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক শহরের নকশা অনুযায়ী গাজা পুনর্গঠনের পরিকল্পনা তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন উদ্যোগকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
১১. বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল
গাজায় একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এতে বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণ করবে এবং শুল্ক, প্রবেশাধিকারসহ বিনিয়োগ সহজতর হবে।
১২. মানুষের স্বাধীনতা
কাউকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হবে না। ইচ্ছা করলে যেকোনো ব্যক্তি যেতে বা ফিরে আসতে পারবে।
১৩. অস্ত্র ধ্বংস ও নিরাপত্তা
হামাস ও অন্যান্য সংগঠন গাজার প্রশাসনে কোনো ভূমিকা নেবে না। সব সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা হবে। অস্ত্র নিষ্ক্রিয় ও আন্তর্জাতিক তহবিল দিয়ে পুনর্গঠন করা হবে।
১৪. আঞ্চলিক অংশীদারদের নিশ্চয়তা
প্রতিবেশী দেশগুলো নিশ্চিত করবে যে নতুন গাজা কোনো হুমকি সৃষ্টি করবে না।
১৫. আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী
যুক্তরাষ্ট্র একটি অস্থায়ী বাহিনী গঠন করবে—‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ)’। এটি নিরাপত্তা রক্ষা, অস্ত্র প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং পুনর্গঠন ত্বরান্বিত করবে।
১৬. ইসরায়েলের ধাপে ধাপে সেনা প্রত্যাহার
আইএসএফ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করলে ইসরায়েলি সেনারা ধাপে ধাপে গাজা ছাড়বে। পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের পরও সীমিত নিরাপত্তা রাখবে।
১৭. নিরাপদ এলাকায় সহায়তা
যদি হামাস প্রস্তাব মানতে বিলম্বিত করে, ইসরায়েল নির্ধারিত নিরাপদ এলাকায় সাহায্য ও পুনর্গঠন চালু করবে।
১৮. আন্তধর্মীয় সংলাপ
গাজায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য একটি আন্তধর্মীয় সংলাপ চালু হবে। এতে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মধ্যে বিশ্বাস ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি পাবে।
১৯. ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ
গাজার পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনে বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি হবে।
২০. রাজনৈতিক সংলাপ
যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করবে, যাতে দীর্ঘমেয়াদে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সহাবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
বিশ্লেষণ ও প্রভাব
বিশ্বজুড়ে শান্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বড় এক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরায়েল ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা মেনে নিয়েছে, তবে হামাসের প্রতিক্রিয়া এখনও অনিশ্চিত।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পরিকল্পনায় জিম্মি মুক্তি, মানবিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সংলাপের মতো বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। তবে বাস্তবায়ন নির্ভর করবে হামাসের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকার ওপর।
গাজা পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা গেলে, উপত্যকার মানুষের জীবনমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হতে পারে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বৃদ্ধি পাবে।
MAH – 13079 I Signalbd.com



