বিশ্ব

গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে, অস্ত্রসমর্পণ না করার ঘোষণা হিজবুল্লাহর

লেবাননের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে, দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ অস্ত্র সমর্পণ ও শান্তি আলোচনায় বসার গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে—ইসরায়েলি আগ্রাসন থামানো না হলে কোনো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। গোষ্ঠীটির মতে, অস্ত্র জমা দেওয়া মানেই আত্মসমর্পণ, যা তাদের আদর্শের পরিপন্থী।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। গোষ্ঠীর উপ-মহাসচিব নাঈম কাশেম এক টেলিভিশন ভাষণে এই কঠিন বার্তা দিয়েছেন সমর্থকদের উদ্দেশে। তার ভাষ্য, ‘নিরস্ত্রীকরণ শব্দটি আমাদের অভিধানে নেই। অস্ত্র সমর্পণ আমাদের অস্তিত্বের ওপর প্রশ্ন তুলবে, যা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।’

ইসরায়েলের হামলা ও ‘প্রতিরোধের অস্ত্র’—হিজবুল্লাহর অবস্থান

লেবাননে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং বারবার সংঘটিত সীমান্ত আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে, হিজবুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের ‘প্রতিরোধী শক্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। নাঈম কাশেম তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের অস্ত্রের কারণেই লেবাননের ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকে আছে। যদি আমাদের হাত খালি হয়ে যায়, ইসরায়েলের সামনে এই দেশের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।’

ইরান-সমর্থিত এই গোষ্ঠীটি মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম সুসংগঠিত এবং সামরিক সক্ষমতায় শক্তিশালী বলে বিবেচিত। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় গত বছর হিজবুল্লাহ সরাসরি তেলআবিবের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয়। ফলে গোষ্ঠীটির সামরিক শক্তি, রাজনৈতিক অবস্থান এবং আঞ্চলিক প্রভাব আরও জোরদার হয়।

গুঞ্জনের শুরু ও রাজনৈতিক চাপ

গত বছরের নভেম্বর মাসে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণের জন্য ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয় দেশই প্রকাশ্যে হিজবুল্লাহর অস্ত্র জমা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।

এ দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়েছে লেবাননের সদ্যগঠিত যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারও। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র হস্তান্তরের পক্ষপাতী মনোভাব প্রকাশ করে।

তবে এরই মধ্যে নানা সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে, নাকি হিজবুল্লাহ নীরবে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে এবং অস্ত্র সমর্পণের পথে হাঁটতে রাজি।

এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার পরই শনিবারের ভাষণে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি বক্তব্য দেন নাঈম কাশেম। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘কেউ কেউ মনে করছে আমরা আমাদের অস্ত্র ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু সত্য হচ্ছে, অস্ত্রই আমাদের শক্তি। এই অস্ত্রই লেবাননের গর্ব এবং আত্মরক্ষার ঢাল।’

হুমকি ও সতর্কবার্তা

ভাষণে কাশেম ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থিত কোনো শক্তি যদি হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে চায় তবে ‘কঠিন জবাব’ দেওয়ার হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন। তার ভাষ্য, ‘যদি আমাদের অস্ত্র কেড়ে নিতে কেউ আসার সাহস দেখায়, তাহলে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। আমরা লড়াই করতেই শিখেছি, মাথানত করতে নয়।’

এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লীগ পরিস্থিতি শান্ত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত লেবাননে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৭১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

কাশেম এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘তেলআবিব চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বারবার। তারপরও আমরা চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আত্মরক্ষার অধিকার কখনোই বিসর্জন দেব না।’

তার দাবি, ইসরায়েলের আগ্রাসন থামানো ছাড়া আলোচনার কোনো পরিবেশ তৈরি হতে পারে না। ‘আমরা আগ্রাসনের শিকার হয়েও শান্তির কথা বলি। কিন্তু কেউ যদি আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে, তাহলে আমরা প্রতিরোধ করবই।’

হিজবুল্লাহর অস্ত্রনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতি

হিজবুল্লাহর অস্ত্রভাণ্ডার, কৌশলগত নীতিমালা ও রাজনৈতিক প্রভাব বরাবরই লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় একটি অনিশ্চয়তার কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, গোষ্ঠীটির অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে উন্নত ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও ভারী অস্ত্র।

ইসরায়েল এই অস্ত্রভাণ্ডারকে ‘সরাসরি হুমকি’ বলে বিবেচনা করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, হিজবুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের স্ট্র্যাটেজিক প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে, যেটা অঞ্চলের ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’র জন্য বড় বাধা।

অন্যদিকে হিজবুল্লাহ বরাবরই নিজেদের ‘প্রতিরোধ আন্দোলন’ আখ্যা দিয়ে দাবি করে আসছে—ইসরায়েলি আগ্রাসন না থামা পর্যন্ত তাদের অস্ত্র সংরক্ষণ অব্যাহত থাকবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হিজবুল্লাহর এই ঘোষণায় লেবাননের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনার সঞ্চার ঘটবে। পাশাপাশি ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সম্পর্কের উত্তপ্ত পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

বেইরুট-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সামির খালাফ বলেন, ‘হিজবুল্লাহর অস্ত্র জমা দেওয়া মানে শুধু তাদের দুর্বলতা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যও বদলে যাবে। এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। কাশেমের বক্তব্য কেবল সমর্থকদের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকেও এই বার্তা দিতে যে, তারা আপসের পথে হাঁটছে না।’

উপসংহার

হিজবুল্লাহর অস্ত্র সমর্পণের গুঞ্জন ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। তবে কাশেমের স্পষ্ট ও দৃঢ় ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে জল্পনা আপাতত স্তিমিত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘোষণায় যেমন লেবাননের রাজনৈতিক সংকট আরও জটিল হবে, তেমনি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তেজনাও বাড়তে পারে। আর তারই মাঝে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর থাকলেও ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘর্ষের হুমকি লাতিন উত্তপ্ত অবস্থানেই রয়ে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button