বিশ্ব

পশ্চিমবঙ্গে ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল রাজ্য, নিহত ৩

পশ্চিমবঙ্গে সংশোধিত ওয়াক্ফ আইন নিয়ে শুরু হওয়া উত্তেজনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় এই আইনবিরোধী সহিংস বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন অন্তত তিনজন। এ ঘটনায় রাজ্যজুড়ে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ১১৮ জনকে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইন পশ্চিমবঙ্গে কার্যকর করা হবে না

কী নিয়ে এই বিক্ষোভ?

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি ওয়াক্ফ আইন ১৯৯৫-এর কিছু ধারা সংশোধন করেছে। সংশোধনের ফলে ওয়াক্ফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাজ্য ও ওয়াক্ফ বোর্ডের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নজরদারি বাড়ে। অনেকের অভিযোগ, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী সম্পদের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের পথ খুলে দিচ্ছে

এই সংশোধনের বিরোধিতা করে মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলায় টানা কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা চলছিল। শুক্রবার (১১ এপ্রিল) সেই বিক্ষোভ রূপ নেয় সহিংস আকারে।

মুর্শিদাবাদে সহিংসতা: নিহত ৩, বহু আহত

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটে। একদল বিক্ষোভকারী রাস্তা অবরোধ করে, গাড়ি ও পুলিশের যানবাহন আগুনে পুড়িয়ে দেয়। শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। পুলিশের পাল্টা লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ার মধ্যে তিনজন নিহত হন। নিহতদের পরিচয় এখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি, তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা সবাই বিক্ষোভকারীদেরই অংশ ছিলেন।

এ ঘটনায় বহু মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা চলছে।

রাজ্য সরকারের অবস্থান: ‘এই আইন কার্যকর হবে না’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সহিংসতার মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (পুরাতন টুইটার) এক পোস্টে লিখেছেন:

“এই আইন কেন্দ্র তৈরি করেছে। আপনারা কোনো কারণে এর বিরোধিতা করলে, কেন্দ্রের কাছেই এর উত্তর চাওয়া উচিত। আমরা এই আইনকে সমর্থন করি না। এই আইন আমাদের রাজ্যে কার্যকর করা হবে না।”

তিনি আরও বলেন, “সব ধর্মের মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে শান্ত থাকুন। ধর্মের নামে কোনো অধার্মিক কাজ করবেন না। দাঙ্গা যারা করছে, তারা সমাজের ক্ষতি করছে।”

পুলিশ ও প্রশাসনের হুঁশিয়ারি

রাজ্য পুলিশের মহাপরিচালক রাজীব কুমার কঠোর ভাষায় আন্দোলনকারীদের সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সহ্য করা হবে না। বিক্ষোভের নামে যারা হিংসাত্মক কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পুলিশ জানিয়েছে, সহিংসতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযান চলছে অন্য অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্যও।

বিজেপির অভিযোগ: ‘তৃণমূল সংখ্যালঘু তোষণে ব্যস্ত’

এই ঘটনার জন্য তৃণমূল সরকারকে দায়ী করেছেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন:

“সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করতে গিয়ে রাজ্য সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে এই ধরনের ভাঙচুর ও সহিংসতা পাঁচ মিনিটেই দমন করা হবে।”

বিজেপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রাজ্যে তৃণমূল সরকারের ‘নরম’ মনোভাবের কারণে আন্দোলনকারীরা সহিংস হয়ে উঠছে।

নতুন ওয়াক্ফ আইন: কী আছে এই সংশোধনে?

সংশোধিত ওয়াক্ফ আইন নিয়ে এখনও অনেকেই পুরো তথ্য জানেন না। মূল যে পরিবর্তনগুলো নিয়ে আপত্তি উঠছে, তা হলো:

  1. ওয়াক্ফ বোর্ডের ক্ষমতা হ্রাস
    – সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন, লিজ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি।
  2. অডিট ও তদন্তে কেন্দ্রের ক্ষমতা বাড়ানো
    – ওয়াক্ফ বোর্ডের কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সরাসরি নজরদারি ও নিরীক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে।
  3. ওয়াক্ফ ঘোষণার ক্ষেত্রে জটিলতা
    – কেউ ওয়াক্ফ ঘোষণা করতে চাইলে তাকে এখন কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

বিক্ষোভকারীদের ভাষ্য, এই আইন মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার ও প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে। তারা এটিকে সংখ্যালঘুদের ওপর বৈষম্যমূলক নীতি হিসেবে দেখছেন।

বিশ্লেষকদের মত: রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তেজনার মিশেল

বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই বিক্ষোভ শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিকও। তৃণমূল সরকার কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, যেখানে সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে ভোটব্যাংক ধরে রাখার চেষ্টা চলছে। অপরদিকে, বিজেপি এই আইনকে জাতীয় স্বার্থ ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরছে।

বিশ্লেষক ড. তানভীর আলম বলেন, “এই আন্দোলন এখন রাজনৈতিক বিতর্কে রূপ নিচ্ছে। সংখ্যালঘু অধিকার বনাম জাতীয় নিরাপত্তা—এই দুই মেরুতে দেশের রাজনীতি আরও মেরুকরণে যাচ্ছে।”

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

ওয়াক্ফ আইন নিয়ে রাজ্যজুড়ে বিতর্কের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও উত্তপ্ত আলোচনা চলছে। #WaqfLawProtest এবং #MurshidabadViolence ট্রেন্ড করছে এক্স (টুইটার)-এ। অনেকে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন, আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে মন্তব্য করছেন।

শান্তির আহ্বান, উত্তেজনার বাস্তবতা

পশ্চিমবঙ্গে ওয়াক্ফ আইন ঘিরে চলমান বিক্ষোভ শুধু একটি আইনি সংশোধনকে ঘিরে নয়, বরং সাম্প্রতিক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতারই প্রতিফলন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং আইন কার্যকর না করার আশ্বাস দিয়েছেন, তবুও মুর্শিদাবাদের নিহত ৩ জনের ঘটনাই প্রমাণ করে—এই ইস্যু কতটা সংবেদনশীল।

অতএব, এখন দরকার সতর্ক প্রশাসনিক পদক্ষেপ, উভয় পক্ষের সংযম, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা—যাতে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট না হয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button