ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোর অবস্থান: ঐক্যের আবরণে বিভাজনের গল্প

ঐতিহাসিক সংকটে আরব বিশ্বের বিভক্ত অবস্থান
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান দীর্ঘকালীন সংঘাতে আরব দেশগুলোর ভূমিকা বরাবরই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। যদিও আরব দেশগুলোর অধিকাংশই ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি সমর্থন করে, কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ এই সমর্থনকে জটিল ও দ্বিমুখী করে তোলে।
নিচে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক—আরব দেশগুলো কীভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নে অবস্থান নিয়েছে, ইতিহাস, বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আলোকে।
জর্ডান: ইতিহাসের দায় ও বর্তমান কৌশল
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় যখন প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হন, তখন বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় নেন জর্ডানে। এরপর ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন জর্ডানে স্থানান্তরিত হয়।
যদিও প্রাথমিকভাবে পিএলও (PLO) জর্ডানকে বেস তৈরি করে ইসরায়েলবিরোধী কার্যক্রম চালাত, পরবর্তীতে এই সম্পর্ক বিরোধে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালের ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামে পরিচিত সংঘাতে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং তাঁদের লেবাননে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে, যার ফলে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল অবস্থান নেয়। তবে জনমতের চাপের কারণে এখনও ফিলিস্তিন প্রশ্নে জর্ডান একটি প্রতীকী সমর্থন অব্যাহত রাখে।
লেবানন: সহিংস ইতিহাস ও নাগরিক অধিকার সংকট
জর্ডান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর পিএলও-এর কেন্দ্র হয়ে ওঠে লেবানন। ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা জড়িয়ে পড়েন এক জটিল রাজনৈতিক খেলায়। সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে ৮০০-র বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়, যার নেপথ্যে ছিল ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট খ্রিস্টান মিলিশিয়া।
বর্তমানে লেবানন সরকার মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও, তাঁদের নাগরিক অধিকার সীমিত রেখেছে। এই নীতিকে সমালোচনা করেছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। সরকারের বক্তব্য হলো—ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বসবাস না করে নিজ দেশে ফেরার সুযোগ রাখা।
মিসর: মধ্যস্থতাকারী ও দ্বৈত ভূমিকা
মিসর ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনিদের ঘনিষ্ঠ সমর্থক। ১৯৭৯ সালে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করলেও, গাজা ও হামাস নিয়ে দেশটির ভূমিকায় রয়েছে দ্বৈততা।
হামাস মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা, যা মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সংগঠন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিসির নেতৃত্বে মিসর হামাসকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং গাজা সীমান্তে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে।
তবে আন্তর্জাতিক শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিসরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালের সংঘাতেও কায়রো ছিল শান্তি প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই): অর্থনীতি আগে, আদর্শ পরে
২০২০ সালে ইউএই ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এটি আরব দুনিয়ায় ফিলিস্তিন ইস্যুকে ঘিরে ঐক্যের পর্দা ছিঁড়ে দেয়।
ইউএইর সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ড্রোন প্রযুক্তি নির্মাতা ইসরায়েলি কোম্পানি ‘থার্ডআই সিস্টেম’-এ ইউএই বিনিয়োগ করে ১০ মিলিয়ন ডলার। এই অবস্থান আরব দুনিয়ায় ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
সুদান: এক সময়ের ‘থ্রি নো’ থেকে আজকের বাস্তবতা
১৯৬৭ সালে সুদানের খার্তুমে ঘোষিত ‘থ্রি নো’ নীতিতে বলা হয়েছিল—ইসরায়েলের স্বীকৃতি নয়, শান্তিচুক্তি নয়, সমঝোতা নয়। কিন্তু ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষক দেশ তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়।
এই পালাবদল মূলত অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কাটাতে খার্তুমের বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়।
কুয়েত: প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশোধের রাজনীতি
ইয়াসির আরাফাতের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা কুয়েতে। কিন্তু ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত আক্রমণে আরাফাতের পক্ষ নেওয়ায় দুই দেশের সম্পর্ক ভেঙে যায়। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করা হয়।
এই সিদ্ধান্তে বহু ফিলিস্তিনি বঞ্চিত হন তাঁদের অধিকার থেকে এবং কুয়েতে তাঁদের পুনরায় গ্রহণ করার সম্ভাবনা এখনও ক্ষীণ।
ইরাক: বন্ধুত্বের অতীত, দুঃস্বপ্নের বর্তমান
সাদ্দাম হোসেনের আমলে ইরাক ছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য এক প্রকার নিরাপদ আশ্রয়। আবাসন, শিক্ষা ও চাকরি—সবই ছিল বিনামূল্যে। তবে ২০০৩ সালের মার্কিন আগ্রাসনের পর শিয়া মিলিশিয়াদের উত্থানে ফিলিস্তিনিরা হয়রানি, নিপীড়ন ও হত্যার শিকার হন।
এখনও অনেক ফিলিস্তিনি ইরাকের নাগরিকত্ব ছাড়াই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
ঐক্যের মুখোশে দ্বন্দ্বের বাস্তবতা
আরব দেশগুলো একদিকে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ করলেও, বাস্তব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই এই নীতির পরিপন্থী। অর্থনীতি, নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক চাপে অনেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে, কেউ আবার নিরব অবস্থান নিয়েছে।
তবে গাজায় একের পর এক হামলা, শরণার্থীদের মানবেতর জীবন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বারবার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে আরব দুনিয়ার ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠ এখন সময়ের দাবি।
চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকাই নির্ধারণ করতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ চিত্র। তাদের কণ্ঠস্বর যতটা উচ্চারিত হবে ন্যায়বিচারের পক্ষে, ততটাই একদিন সম্ভব হবে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়া।
আপনি চাইলে এ নিয়ে একটি ইনফোগ্রাফিক, ভিডিও স্ক্রিপ্ট বা সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্টও বানিয়ে দিতে পারি। বললেই তৈরি করে দিচ্ছি।