দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ৩ জুন

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নাটকীয় পরিবর্তনের পর দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে আগামী ৩ জুন ২০২৫। দীর্ঘ এক অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে মঙ্গলবার দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু এ ঘোষণা দেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এই সিদ্ধান্ত এসেছে একটি অস্থির ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক পটভূমিতে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল-এর সামরিক শাসনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সাংবিধানিক আদালত তাকে অভিশংসন করে পদচ্যুত করে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে রয়ে গেছে।
সূত্র: রয়টার্স, ইত্তেফাক, সরকারি বিবৃতি
নেতৃত্বহীন সময় ও গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে দক্ষিণ কোরিয়া কার্যত নেতৃত্বহীন অবস্থায় ছিল। ইউন সুক ইওল সেনাবাহিনীর সহায়তায় বেসামরিক প্রশাসনকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালান, যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল বলে বিবেচিত হয়। এর প্রেক্ষিতে দেশের সাংবিধানিক আদালত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তাকে অভিশংসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়।
এমন অবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র এক অনিশ্চিত পথে চলতে থাকে। নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় দেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে সাম্প্রতিক আদালতের রায়ে ইউন-এর অভিশংসন বহাল রাখা হয় এবং সেই সঙ্গে নতুন নির্বাচনের জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
নির্বাচন প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতির ঘোষণ
প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু গণমাধ্যমকে জানান, নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সরকারের নিবিড় আলোচনা হয়েছে। আলোচনা শেষে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য ৩ জুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় যা ২১তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হবে।
হ্যান আরও জানান, নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ৩ জুনকে একটি অস্থায়ী সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হবে যাতে সব ভোটার তাদের সাংবিধানিক অধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করতে পারেন।
নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপ
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বরাবরই বড় রাজনৈতিক উৎসব ও জনমত যাচাইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে এবারকার নির্বাচন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামো হুমকির মুখে পড়েছিল।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যেই কৌশলগত প্রস্তুতি শুরু করেছে। নতুন প্রার্থীদের নাম ঘিরে জনমত জরিপ, গণসংযোগ এবং রাজনৈতিক সমীকরণ শুরু হয়েছে। সরকারপন্থি ও বিরোধীদলীয় উভয় শিবিরই এবারের নির্বাচনকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে দেখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পর দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ এখন নতুন নেতৃত্ব ও স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকারই হবে এবারের নির্বাচনের মূলমন্ত্র।
হ্যান ডাক-সু: দায়িত্ব ও প্রত্যাশা
বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনিই আপাতত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সরকারি সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের আস্থা ফেরাতে নির্বাচনী পরিবেশ আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সংবিধানের দৃষ্টিকোণ
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট অপসারিত হলে তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তবে ইউন-এর অপসারণের পর প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা সমালোচনা হয়।
এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে, আদালতের রায়, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের জটিলতায় কিছুটা সময়ক্ষেপণ হয়েছে। তবে এখন নির্বাচন ঘোষণার মাধ্যমে এই প্রশ্নের অবসান ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই নাটকীয় পরিবর্তনের ওপর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিও নিবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তারা সিউলে একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের আশা প্রকাশ করেছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার মত একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামরিক শাসনের মতো সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের জন্য এক গুরুতর হুমকি। তাই ৩ জুনের নির্বাচন শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিসাব নয়, এটি হবে দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি গৌরবময় অধ্যায়।
শেষ কথা
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৫ অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি নতুন নেতৃত্বের উত্থান যেমন ঘটাবে, তেমনি বিগত রাজনৈতিক সংকটেরও সমাপ্তি টানবে। রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, সাংবিধানিক শাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে এই নির্বাচন হবে দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন ইতিহাস লেখার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
জনগণের ভোটই হবে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের হাতিয়ার—সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া।