ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করল আফ্রিকান ইউনিয়ন

আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তপ্ত আবহে নতুন করে আলোচনায় এসেছে আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক। পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এইউ— এমন এক সিদ্ধান্ত যা শুধু কূটনৈতিক অঙ্গনে নয়, গোটা বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতের বহিষ্কার: ঘটনার পেছনের কাহিনি
ইসরায়েলভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, রুয়ান্ডার টুটসি জনগণের গণহত্যার স্মরণে আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত। ওই কর্মসূচিটি পূর্ব-নির্ধারিত ছিল এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।
কিন্তু অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতি নজরে আসতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি প্রকাশ্যে ইসরায়েলের নীতির সমালোচনা করেন এবং রাষ্ট্রদূতকে অনুষ্ঠান ত্যাগ করতে বলেন। পরে এইউ এক বিবৃতিতে জানায়, ভবিষ্যতে কোনো কর্মসূচিতে ইসরায়েলের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না এবং তাকে সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ঘটনায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন বলেন, “এইউ কমিশনের চেয়ারম্যানের এমন আচরণ কূটনৈতিক সৌজনবোধের পরিপন্থী। এটি শুধু ইসরায়েল নয়, বরং গণহত্যার শিকারদের প্রতিও অসম্মান।”
তিনি আরও বলেন, “রুয়ান্ডা ও ইহুদি জনগণ উভয়েই ইতিহাসের ভয়াবহ জাতিগত সহিংসতা ও গণহত্যার শিকার। সেই বাস্তবতা অস্বীকার করা এক ধরনের কূটনৈতিক অসচেতনতা।”
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
গাজা যুদ্ধ ও আফ্রিকান ইউনিয়নের অবস্থান
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলে ঢুকে আকস্মিক হামলা চালালে নতুন করে শুরু হয় সংঘাত। হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। সেই থেকেই ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে, যার মেয়াদ ১৫ মাস ছাড়িয়ে গেছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন ৫০ হাজার ৭০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি, যার ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষত জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজায় এই অভিযানকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে আফ্রিকান ইউনিয়ন শুরু থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা—এইউ-এর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য দেশ—গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করেছে। আইসিজে-তে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) দায়ের হওয়া এই মামলায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
আফ্রিকান ইউনিয়নের ভূমিকায় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আফ্রিকান ইউনিয়নের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কিছু দেশ এইউ-এর সিদ্ধান্তকে ‘মানবাধিকারের পক্ষে সাহসী অবস্থান’ বলে অভিহিত করলেও, অনেকে এটিকে একপাক্ষিক ও অরাজনৈতিক আচরণ বলেও সমালোচনা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকান ইউনিয়নের এমন সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন ইসরায়েলের কূটনৈতিক সংকটকে বাড়াবে, অন্যদিকে তা বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলের সমর্থকদেরও চাপে ফেলবে। কারণ, একের পর এক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও রাষ্ট্র ইসরায়েলের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, যা দেশটির জন্য এক ধরনের বৈশ্বিক কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে পারে।
হামাস জিম্মি ইস্যু ও আইডিএফের ঘোষণা
গাজা আগ্রাসনের পেছনে ইসরায়েলের অন্যতম যুক্তি হলো—হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি। ২৫১ জন জিম্মির মধ্যে এখনও প্রায় ৩৫ জন জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, এই জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য তারা যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযান কেবলমাত্র জিম্মিদের উদ্ধার নয়, বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। নেতানিয়াহু বারবার জানিয়েছেন, হামাসকে পুরোপুরি দুর্বল করা না পর্যন্ত গাজায় অভিযান থামবে না।
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক চিত্র
গাজায় চলমান সংঘাত এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো বৃহৎ সংগঠনের প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলছে। একদিকে মানবিক সংকট, অন্যদিকে বৈশ্বিক কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব—এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে গেছে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল উভয় জনগোষ্ঠী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকান ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত বিশ্ব কূটনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি শুধু ইসরায়েলের একক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের পক্ষেও একটি স্পষ্ট বার্তা।
উপসংহার
আফ্রিকান ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক ধাক্কা। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের সংকট ও মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংগঠনের ক্রমাগত চাপ—সব মিলিয়ে ইসরায়েল এখন বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে। এই পরিস্থিতিতে সংলাপ, সমঝোতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগই হতে পারে শান্তির একমাত্র উপায়।