চীনকে কোণঠাসা করতেই কি পুতিনকে কাছে টানছেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক ঘিরে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত ইউক্রেন সংকট নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং পুতিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বৈশ্বিক বিশ্লেষকদের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলছে।
ট্রাম্পের ইউক্রেন নীতি এবং বিতর্ক
হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক বাক্বিতণ্ডা নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। ইউক্রেনের ব্যাংক কর্মকর্তা জিনাইদা শেলেনেঙ্কো বলেছেন, “তাঁরা দুজন ডাকাতের মতো করে জেলেনস্কিকে কোণঠাসা করেছেন। তাঁরা আপনার অর্থ চান এবং একই সঙ্গে অপমান করতে চান—যেন দুজন মাফিয়া।”
শুক্রবারের এই ঘটনার পর গত সোমবার ট্রাম্প ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন। এতে কিয়েভ ও ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী গভীর সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা বন্ধের সম্ভাব্য প্রভাব
ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক মিখাইলো জিরোকভের মতে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে মার্কিন অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও অর্থনৈতিক ও আইনি সমস্যায় পড়বে। এর পাশাপাশি, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সুযোগও কমে আসবে, যা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পরিচালনার জন্য পাইলট ও কর্মীদের প্রশিক্ষণও বন্ধ হতে পারে। এটি ইউক্রেনের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, কারণ তাদের কাছে রাশিয়ার বিমান হামলা প্রতিরোধের বিকল্প কৌশল খুবই সীমিত।
রাশিয়ার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা
ইউক্রেনে মার্কিন অস্ত্র চালান স্থগিত করার ফলে দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কিয়েভ ও ওদেসার মতো শহরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করা রয়েছে। মার্কিন সহায়তা বন্ধ হলে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা কমে যাবে এবং রাশিয়ার ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ইউক্রেন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচ মনে করেন, বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ট্রাম্প মূলত চীনকে মোকাবিলা করতেই মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চাইছেন। তিনি বলেন, “ট্রাম্প মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারেন এবং পুতিনকে ওয়াশিংটনের পাশে রাখতে চাইছেন, যাতে চীন থেকে রাশিয়াকে দূরে সরিয়ে আনা যায়।”
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
ইউক্রেনের সাবেক ইতিহাস শিক্ষক আনাতোলি মনে করেন, ট্রাম্পের বর্তমান নীতির সঙ্গে অষ্টাদশ শতকে পোল্যান্ডের ভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনার মিল রয়েছে। সে সময় পোল্যান্ডের পার্লামেন্ট অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত থাকায় রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া দেশটির অংশ দখল করেছিল। আনাতোলি বলেন, “ইউক্রেনও একই পথে হাঁটছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা বাড়ানোর পরিবর্তে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় সময় নষ্ট করেছে তারা।”
ইউরোপের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিনের মতে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানে পরিবর্তন আনতে পারে। ইউরোপীয় দেশগুলো সম্ভবত এখন ইউক্রেনকে আরও বেশি সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য হবে।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওয়াশিংটন ও কিয়েভের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। তবে ট্রাম্পের নীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য কী এবং এতে ভূরাজনৈতিকভাবে কার লাভ-কার ক্ষতি হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।