ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রমজানকে স্বাগত জানাল গাজাবাসী

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ফের মাহে রমজানের আগমন ঘটেছে। বিশ্বজুড়ে যখন মুসলিম সম্প্রদায় রমজানের আনন্দে মেতে উঠেছে, তখন গাজার মানুষ দুঃখ, কষ্ট আর অনিশ্চয়তার মাঝে এ পবিত্র মাস পালন করছে। গাজার শহরগুলোর ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষ রমজানের প্রথম রোজা পালন করেছে, যদিও শান্তি ও নিরাপত্তার আশঙ্কা এখনও কাটেনি।
যুদ্ধের ক্ষত এখনও টাটকা
গাজায় যুদ্ধের ভয়াবহতা এখনও মানুষের স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করছে। চলমান যুদ্ধবিরতি যে স্থায়ী হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপ, বিদ্যুৎহীন রাত, খাদ্যের অভাব, ওষুধের সংকট- সব মিলিয়ে এক অসহনীয় অবস্থা। প্রতিদিন মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছে, কখন যুদ্ধ আবার ফিরে আসবে সে চিন্তায়।
গত বছরও রমজান মাসের প্রায় পুরোটা সময় গাজাবাসী বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে কাটিয়েছে। বহু রোজার রাত কেটেছে বোমার শব্দের মাঝে, ক্ষুধার্ত অবস্থায়। ইফতার ও সেহরির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকেই শুধুমাত্র এক বোতল পানীয় ভাগ করে রোজা রেখেছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে টেবিলের নিচে লুকিয়ে ইফতার করতে হয়েছিল অনেককে।
পরিবারের বিচ্ছিন্নতা ও হারানোর বেদনা
গাজার মানুষ বছরের পর বছর ধরে তাদের আপনজনদের হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছে। বোমার আঘাতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেকে। কেউ বাবা-মাকে হারিয়েছে, কেউবা সন্তানকে। এ বছর রমজানের ইফতার টেবিলে হয়তো সেই হারানো প্রিয়জনের জন্য নির্ধারিত আসনটি খালি থাকবে। অনেক মা আর ইফতার বানাতে পারবেন না, কারণ তারা নিজেরাই হয়তো এ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন।
আমার নিজের ফুফাকে হারিয়েছি গত বছর। প্রতি রমজানে তিনি আমাদের দাওয়াত করতেন। এখন আর তার হাসিমুখ দেখতে পাবো না। আমার বান্ধবী সায়মা, লিনা ও রোয়া— তারা সবাই এই বর্বর হামলায় নিহত হয়েছে। আগে তারাবির নামাজের পর তাদের সঙ্গে দেখা হতো, এবার আর তাদের দেখা পাবো না।
ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন বাজার, আলোয় ভাসছে কিছু এলাকা
যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পরও গাজার মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের উপরই তৈরি হয়েছে ছোট ছোট বাজার। রমজান উপলক্ষে দোকানপাট খুলেছে, মানুষ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু স্থানে রঙ-বেরঙের বাতি জ্বলছে, যার ফলে রমজানের আমেজ কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে। তবে খাদ্য ও পানির সংকট এখনও প্রকট।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বেশিরভাগ মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। গ্রেট ওমারি মসজিদ, যেখানে আগে রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা হতো, কুরআন তিলাওয়াত করা হতো— সেটিও আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপ। মসজিদ না থাকলেও মানুষের বিশ্বাস অটুট রয়েছে। তারা তাবু গেড়ে তারাবিহ আদায় করছে, কুরআন পড়ছে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করছে।
নতুন বাস্তবতায় রমজানের ইবাদত
রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও গাজার মানুষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে ভুলছে না। ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য তারা দিনরাত দোয়া করছে। এই কঠিন সময়েও তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ধরে রেখেছে।
রমজানের সেহরি ও ইফতার এখন আর আগের মতো নয়। নিরাপত্তাহীন পরিবেশ, খাবারের সংকট এবং পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতি— এসব কিছু মিলে রমজানের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। তারাবির নামাজ পড়তে কোথায় যাবেন, সেটা কেউ নিশ্চিত নন। কেউ ধ্বংসস্তূপের নিচে, কেউবা খোলা আকাশের নিচে নামাজ আদায় করছে।
নিঃসঙ্গ রমজান, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের শূন্যতা
গাজায় এবারের রমজান এসেছে নিঃসঙ্গতার বার্তা নিয়ে। যারা বেঁচে আছেন, তারা তাদের প্রিয়জনদের অভাব গভীরভাবে অনুভব করছেন। ইফতারের সময় হয়তো সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো আর দেখা যাবে না। কেউ ভাইকে হারিয়েছে, কেউ সন্তানকে। এই শূন্যতা কখনোই পূরণ হবে না।
তবে গাজার মানুষ আশায় বুক বাঁধে। তারা জানে, একদিন হয়তো শান্তি ফিরে আসবে। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে তারা রমজানকে স্বাগত জানাচ্ছে, কারণ তারা জানে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও নতুন জীবনের আলো জ্বলে ওঠে। তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাদের এই কষ্টের উত্তম প্রতিদান দেবেন।