মিয়ানমারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার উদ্যোগ

রাশিয়া মিয়ানমারে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। গতকাল (৪ মার্চ) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রধান মিন অং হ্লেইংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তির আওতায়, রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু শক্তি সংস্থা রোসাটমের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রোসাটম এই প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে। কেন্দ্রটি নির্মাণের পর এর পরিচালনার দায়িত্বও থাকবে রোসাটমের হাতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমার বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
রাশিয়া-মিয়ানমার সম্পর্কের পটভূমি
রাশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রয়েছে। বিশেষত, সামরিক খাতে রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হলো রাশিয়া। কিছুদিন আগেই মস্কোর কাছ থেকে ৬টি যুদ্ধবিমান কেনে নেপিদো।
২০০০ সালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। রাশিয়া থেকে সামরিক সহায়তা পাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ও জ্বালানি খাতেও মিয়ানমার বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে।
মিয়ানমারের বিদ্যুৎ সংকট ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গুরুত্ব
মিয়ানমার বর্তমানে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে রয়েছে। দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূলত জলবিদ্যুৎ ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে জলবিদ্যুতের উৎস বর্ষাকাল নির্ভরশীল হওয়ায় এবং কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশগত দিক থেকে ক্ষতিকর হওয়ায়, বিকল্প শক্তির সন্ধানে রয়েছে দেশটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে মিয়ানমারের বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। এটি শুধু দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াবে না, পাশাপাশি শিল্প খাতের সম্প্রসারণেও সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে রাশিয়ার চুক্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এই চুক্তি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা আশঙ্কা করছে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও এই চুক্তির ব্যাপারে সমালোচনা করছে। তাদের মতে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতা সুসংহত করতে পারে, যা দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে।
রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার এই উদ্যোগ শুধুমাত্র বাণিজ্যিক প্রকল্প নয়, বরং এর মাধ্যমে দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করতে চায়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া বিকল্প বাজার ও মিত্র খুঁজছে, যেখানে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ জ্বালানি পরিকল্পনা
মিয়ানমারের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৫% পারমাণবিক শক্তি থেকে উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেছে। এটি বাস্তবায়িত হলে, দেশটির জ্বালানি খাতের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উপসংহার
মিয়ানমারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিটি দেশটির জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এটি মিয়ানমারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, তবে আন্তর্জাতিক মহলে এই চুক্তি নিয়ে উদ্বেগ ও বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রকল্প কীভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং এটি মিয়ানমারের জনগণের জন্য কীভাবে উপকার বয়ে আনে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।