বিশ্ব

তালেবানের জোড়াতালির সরকার পতনের দিকে যাচ্ছে

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার বর্তমানে একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। ২০২১ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে তারা তাদের সহিংস আন্দোলনকে একটি কার্যকর সরকারব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। তবে, তালেবান সরকারের মধ্যে ঐক্যের একটি বাহ্যিক প্রদর্শন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এর আড়ালে রয়েছে গভীর উপদলীয় কোন্দল, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং জন–অসন্তোষ।

অভ্যন্তরীণ বিভক্তি

বিশ্লেষক মাবিন বাইক তাঁর ‘তালেবান’স ইন্টারনাল পাওয়ার স্ট্রাগল: আ রেজিম অন দ্য ব্রিক’ শিরোনামের প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, তালেবানের সবচেয়ে বড় অস্তিত্বগত হুমকি হচ্ছে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ নয়, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি। এই বিভক্তি যদি সামাল দেওয়া না যায়, তাহলে তা তালেবান সরকারের পতন ডেকে আনতে পারে এবং আফগানিস্তানকে আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

নেতৃত্বের সংকট

তালেবান সরকারের নেতা মোল্লা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নেতৃত্বে তালেবান আন্দোলন নুরজাই গোত্রকে কেন্দ্র করে আরও বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এ গোত্রের পছন্দ-অপছন্দের কাছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তালেবান নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। প্রয়াত নেতা মোল্লা ওমর নেতৃত্বের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু আখুন্দজাদাকে সেই স্তরের কর্তৃত্ব অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

মোল্লা ইয়াকুব ও মোল্লা বারাদারের মতো মূল নেতারা তালেবানের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি গড়ে তুলেছেন, ফলে তালেবানের মধ্যে বেশ কিছু প্রভাবকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সংঘাত তৈরি হচ্ছে, যা সরকারের অস্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে।

অর্থনৈতিক সংকট

আফগানিস্তানের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তালেবান সরকারের নেতৃত্বের লড়াইকে তীব্র করেছে। তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে দেশটি বিদেশি সহায়তা ও প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করত। কিন্তু এখন বৈধ অর্থায়নের উৎস সীমিত হয়ে গেছে। ফলে, তালেবান সরকারকে হাজি বশির নুরজাইয়ের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত খনি পরিচালনার আয় এবং সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরোপ করা ব্যাপক করের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

জানুয়ারি মাসে স্থানীয় আফগান মুদ্রার মান অবনমনের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ইউএসএআইডির সহযোগিতা বন্ধ হওয়ার কারণে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণে জানুয়ারি মাসে তালেবান সরকার অদক্ষ পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে বিমানবন্দর দিয়ে ৫ হাজার ডলার এবং স্থলবন্দর দিয়ে ৫০০ ডলারের বেশি স্থানান্তর করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি

ফেব্রুয়ারি মাসে বিতর্কিত স্থাপনা নির্মাণের কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে তোর্কহাম সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়, যা খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। তালেবানের কট্টর নীতি, বিশেষ করে নারী অধিকারের ওপর বিধিনিষেধ বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে স্তিমিত করে দিয়েছে। পশ্চিমা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতারা এমন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে শঙ্কিত থাকে, যারা তাদের অবস্থানের ক্ষেত্রে অনড়।

কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা

তালেবানের অতিরিক্ত দমনমূলক নীতির কারণে সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে কম আগ্রহ দেখাচ্ছে। এমনকি যেসব দেশ ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, সেসব দেশও এখন ন্যূনতম সহযোগিতার বাইরে বাড়তি কিছু দিতে দ্বিধাগ্রস্ত।

ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পালাবদলের পর ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধ করার বিষয়টি নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। রিপাবলিকান সিনেটর টিম শেডি ‘কোনো করদাতা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করতে পারে না’ শীর্ষক যে বিলটি এনেছেন, তার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন ফেডারেল সহযোগিতা যাতে আফগানিস্তানে না পৌঁছায়।

ভবিষ্যৎ সংকট

আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা গোপনে বিকল্প শক্তিগুলোকে সমর্থন দিতে পারে। তালেবানের বিরুদ্ধে জমে ওঠা অসন্তোষের মধ্যে নিজেদের ভিত্তি গাড়ার জন্য উর্বর ভূমি খুঁজে পাচ্ছে চরমপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেট।

তালেবান সরকারের অস্থিতিশীলতা এবং অভ্যন্তরীণ বিভক্তি তাদের পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদি তারা এই সংকট মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আফগানিস্তান আবারও একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা এবং আফগান জনগণের জন্য একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button