বাংলাদেশ

ফকিরহাটে মাছের ঘেরের ওপরে ঝুলছে রঙিন তরমুজ

Advertisement

ফকিরহাটের নতুন কৃষি উদ্ভাবন: মাছের ঘেরের ওপরে তরমুজ চাষ

বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার কৃষকরা এখন ব্যস্ত মাছের ঘেরের ওপরে ঝুলন্ত মাচায় তরমুজ ফলাতে। নানা রঙের তরমুজের সারি সারি গাছ যেন কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এই অভিনব চাষ পদ্ধতি কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করছে, পাশাপাশি দেশের কৃষি খাতে এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

ফকিরহাট উপজেলার নলধা-মৌভোগ ইউনিয়নের কৃষক নিতুল রায়ের ঘেরে এখন ঝুলছে হলুদ, সবুজ ও কালো রঙের অমৌসুমি তরমুজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো সবজি বাগান, কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় এটি মাছের ঘেরের ওপরে নির্মিত ঝুলন্ত মাচার তরমুজ চাষ।

কীভাবে হচ্ছে মাছের ঘেরে তরমুজ চাষ?

প্রচলিতভাবে তরমুজ চাষ হয় খোলা মাঠে। কিন্তু ফকিরহাটের কৃষকরা এবার বেছে নিয়েছেন মাছের ঘেরের ওপরে মাচা তৈরি করে তরমুজ চাষের অভিনব পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে ঘেরের আইলের ওপর তরমুজের গাছ রোপণ করা হয়, আর লতাগুলি মাচায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে গাছের নিচে ঝুলে থাকে ফল। পানির ওপরে মাচা থাকায় কোনো বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না, আর ঘেরের জায়গা অপচয়ও হয় না।

উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই পদ্ধতিতে অতিবৃষ্টি বা জলাবদ্ধতার ভয় নেই। কারণ, আইলগুলো উঁচু হওয়ায় বন্যা বা অতিরিক্ত পানির ক্ষতি হয় না। একইসঙ্গে, কীটনাশকের ব্যবহারও খুব সীমিত, কারণ মাছের ক্ষতি এড়াতে কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। ফলে এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর।

কৃষি বিভাগের ভূমিকা ও পরিসংখ্যান

ফকিরহাট উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে উপজেলার আটটি ইউনিয়নে প্রায় ১০ হেক্টর জমিতে ৮০ জন কৃষক মাছের ঘেরে তরমুজ চাষ করেছেন।

কৃষি বিভাগ কৃষকদের দিয়েছে বীজ, সার, প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত পরামর্শ। ফলে প্রথমবারেই কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছেন। বিভাগটির দাবি, ভবিষ্যতে আরও বেশি কৃষক এই পদ্ধতিতে তরমুজ চাষে আগ্রহী হবেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন:

“বর্তমানে ফকিরহাটে চার জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে— তৃপ্তি, ফর্মেলো, বিগ ফ্যামিলি ও ছক্কা। এই জাতগুলো স্বাদে ভালো এবং বাজারে দামও বেশি। কৃষকদের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে আগামীতে আরও বেশি জমিতে তরমুজ চাষ হবে।”

কৃষকের অভিজ্ঞতা: লাভের মুখ দেখছেন সবাই

নলধা-মৌভোগ ইউনিয়নের কৃষক নিতুল রায় বলেন:

“প্রথমবার মাছের ঘেরে তরমুজ চাষ করতে খরচ হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছি। আশা করছি আরও দেড় লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারব।”

তিনি আরও জানান,

“প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৪৫-৫০ টাকা দরে। বিশেষ জাতের হলুদ তরমুজ ‘তৃপ্তি’ বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। খুচরা বাজারে দাম আরও বেশি।”

একই এলাকার কৃষক নিরাপদ বৈরাগী এবং বিশ্বজিৎ সরকার জানান, তাঁরা কৃষি বিভাগের পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরমুজ চাষ শুরু করেছেন। বাজারে চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি হওয়ায় আগামী মৌসুমে আরও বেশি জমিতে চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া: স্বাদে ও গুণে অনন্য

ফকিরহাট বাজারের ডাকবাংলো মোড়ে তরমুজ কিনতে আসা শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন:

“দুই দিন আগে একটি তরমুজ কিনেছিলাম। এত মিষ্টি ও সুস্বাদু ছিল যে আজ আবার কিনতে এসেছি।”

উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে এখন এসব তরমুজ আশপাশের জেলায়ও যাচ্ছে।

কেন এই পদ্ধতি কৃষিতে বিপ্লব আনবে?

✔ জমি সাশ্রয় হয়
✔ মাছ ও কৃষি একসাথে উৎপাদন
✔ ঝুঁকি কম
✔ লাভ বেশি
✔ বাজারে অফ সিজনে তরমুজের চাহিদা বেশি

অফ সিজনে তরমুজ চাষ কৃষকদের জন্য লাভজনক ব্যবসা। একদিকে মাছ বিক্রি, অন্যদিকে তরমুজ বিক্রি—দু’দিকেই আয় বাড়ছে। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই পদ্ধতি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে।

তরমুজের জাত ও দাম

ফকিরহাটে মূলত চারটি জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে—

  • তৃপ্তি (হলুদ তরমুজ): কেজি ৯০-১০০ টাকা
  • ফর্মেলো: কেজি ৪৫-৫০ টাকা
  • বিগ ফ্যামিলি: কেজি ৫০ টাকা
  • ছক্কা: কেজি ৫০-৫৫ টাকা

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার মতামত

মৌভোগ ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিপ্লব দাস বলেন:

“অফ সিজনে তরমুজ একটি লাভজনক ফসল। অনেক কৃষক প্রথমবার চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। বাজারে তরমুজের চাহিদা ও দাম দুটোই ভালো।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, আগামী মৌসুমে আরও বেশি কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চাষের এলাকা বাড়ানো হবে এবং আরও উন্নত জাতের তরমুজ আনা হবে। লক্ষ্য হলো—বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অফ সিজন তরমুজ চাষের বিপ্লব ঘটানো।

MAH – 12646,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button