বিশ্ব

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে হামাসের সম্মতি, ইসরায়েলের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকেত

Advertisement

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিনের সংঘাতের পর হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির সর্বশেষ প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। পাশাপাশি তারা মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনকারি এই সংগঠনটি এমন তথ্য দিয়েছে কাতার ও মিসরের মাধ্যমে।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত ৬২,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছেন। ইসরায়েলের হামলার কারণে খাদ্যাভাবে মৃত্যু এবং বিশাল সংখ্যক বাস্তুচ্যুতির নতুন হুমকিও দেখা দিয়েছে।

হামাস গতকাল সোমবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা কাতার ও মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল ও চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার এই তথ্য পেয়েছে।

যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী

সূত্রের বরাতে জানা গেছে, সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • ৬০ দিনের জন্য সামরিক অভিযান স্থগিত রাখা।
  • এই সময়ে ইসরায়েলি সেনারা গাজার বাইরে সরে যাবে, যাতে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়।
  • ৫০ ইসরায়েলি জিম্মির অর্ধেককে মুক্তি দেওয়া হবে, বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।

এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার ঘোষণা এসেছে কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন জসিম আল থানি এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিয়ের মধ্যে কায়রোতে সাক্ষাতের পর।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর মানে এই নয় যে গাজা যুদ্ধ খুব শিগগিরই শেষ হতে চলেছে। কারণ আগের ব্যর্থ আলোচনাগুলো প্রমাণ করেছে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিকে শুধুমাত্র অস্থায়ী এবং নিজের কৌশলগত সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে চায়।

হামাস বনাম ইসরায়েলের মূল বিরোধ

হামাস বারবার চায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং স্থিতিশীল শান্তি, কিন্তু ইসরায়েলের লক্ষ্য মূলত অস্থায়ী বিরতি, যাতে তারা গাজার ফিলিস্তিনিদের উপর প্রভাব বজায় রাখতে পারে এবং জিম্মি মুক্তির পর আবার ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে।

গত দুই বছর ধরে হামাস বিভিন্ন সময় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, কিন্তু ইসরায়েল নানা অজুহাতে এগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশেষ করে গাজার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো দখল ও ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির পরিকল্পনার কারণে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।

গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা

ইসরায়েল গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গাজার একসময়ের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ নগর থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা বোমা নিক্ষেপ করছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার দাবি, “হামাস এখন ব্যাপক চাপে রয়েছে।”

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, “হামাস আলোচনায় রাজি হচ্ছে কেবল এই কারণে যে তারা জানে আমরা গাজা সিটি দখলে অটল।”

কট্টর দক্ষিণপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ যেকোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, “হামাস তাদের ধ্বংস হতে দেখছে। আংশিক চুক্তির মাধ্যমে বাঁচতে চাইছে। এজন্য আমাদের কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়।”

মানবিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

গাজার বাসিন্দারা দিনরাত বোমা বিস্ফোরণ, খাদ্যসংকট ও বিশাল বাস্তুচ্যুতির শিকার হচ্ছেন। শিশু ও নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার দলগুলি ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং দ্রুত মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী ও খাদ্য সরবরাহ করতে বিলম্ব হলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও মধ্যস্থতা

কাতার ও মিসর যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে কাতার ও মিসরের নেতৃত্বে হঠাৎই আলোচনার ভিত্তি তৈরি হয়েছে, যা হামাসকে প্রস্তাব মেনে নিতে উৎসাহিত করেছে।

তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের কট্টর নীতির কারণে এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।

যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

যদি এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তবে:

  • গাজার মানুষ সাময়িকভাবে স্বস্তি পাবে।
  • মানবিক সহায়তা পৌঁছানো সহজ হবে।
  • কিছু জিম্মি মুক্তি পাবে, যা দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমাবে।

কিন্তু ইসরায়েল যদি আগের মতো আচরণ করে, তাহলে নতুন করে সহিংসতা শুরু হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, “এই যুদ্ধবিরতি কেবল সময়ের জন্য শান্তি এনে দিতে পারে; স্থায়ী সমাধান নয়।”

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত এখনো সমাধানহীন। হামাস যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নিয়েছে এবং আলোচনায় বসতে চাচ্ছে। তবে ইসরায়েলের কৌশল, গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের চাপের কারণে যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান এখনও দূরদূরান্তে।

বিশ্বের নজর এখন গাজার উপর, যেখানে মানবিক বিপর্যয়, জিম্মি মুক্তি ও শান্তি প্রক্রিয়া একসাথে সংঘর্ষে পরিণত হচ্ছে। যুদ্ধবিরতির এই নতুন প্রস্তাব কি স্থায়ী শান্তি আনতে সক্ষম হবে, সেটি সময়ই বলবে।

MAH – 12411 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button