সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এয়ারশোতে ভারতীয় স্বদেশী লাইট কমব্যাট ফাইটার জেট তেজস বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনা ভারতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে ধরা হচ্ছে। দীর্ঘ বছরের পরিশ্রম ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলশ্রুতিতে তৈরি এই যুদ্ধবিমানটি ভারতের জন্য শুধু জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীকই নয়, বরং বিদেশি বাজারে রপ্তানি সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ দুর্ঘটনার কারণে তেজস এখন দেশের ভিতরে অর্ডার পূরণের দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হতে পারে। রোববার (২৩ নভেম্বর) রয়টার্সের প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
দুবাই এয়ারশোতে দুর্ঘটনার বিস্তারিত
প্রদর্শনীর শেষ দিনে তেজস হঠাৎ বিধ্বস্ত হয়। পাইলট উইং কমান্ডার নমনশ সিয়াল এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। যদিও দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, তবে এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
দুবাই এয়ারশোতে ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানও অংশ নেয়। উল্লেখযোগ্য, মাত্র ছয় মাস আগে দুই দেশের বিমান বাহিনী কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকাশযুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারশোতে অংশ নেওয়া ছিল একটি কৌশলগত প্রদর্শনী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন প্রকাশ্য দুর্ঘটনা তেজসের বিদেশি বিপণন প্রচেষ্টা ও রপ্তানি সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে তেজসকে বিদেশি বাজারে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিল, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে।
বিশ্ব প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকদের মত
মার্কিন মিচেল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ডগলাস এ. বার্কি বলেন, “এ ধরনের দুর্ঘটনা দৃশ্যত খুবই কঠিন। যখন দেশগুলো নিজেদের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়, তখন এমন ঘটনা একেবারে উল্টো বার্তা দেয়—স্পষ্ট ব্যর্থতা।” তবে তিনি উল্লেখ করেন, দীর্ঘমেয়াদে তেজস আবারও তার গতি ফিরে পাবে।
দুবাই এয়ারশো প্যারিস ও ফার্নবারোর পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এয়ারশো। যদিও এখানে দুর্ঘটনা বিরল, এর আগে ১৯৯৯ সালে প্যারিস এয়ারশোতে রাশিয়ান এসইউ-৩০ বিধ্বস্ত হয়েছিল, তার এক দশক আগে একই শোতে মিগ-২৯ বিধ্বস্ত হয়েছিল। সেই সমস্ত ক্ষেত্রেই পাইলটরা প্রাণ রক্ষা করেছিল।
বার্কি মনে করান, যুদ্ধবিমান বিক্রি মূলত রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিয়ন্ত্রিত হয়। একটি দুর্ঘটনা তা একেবারে পরিবর্তন করতে পারে না।
তেজস প্রকল্পের পটভূমি
১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের বিকল্প হিসেবে তেজস প্রকল্প শুরু হয়। তবে ধীর সরবরাহ ও প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে মিগ-২১-এর জীবনকাল বারবার বাড়ানো হয়েছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই মিগ-২১-এর শেষ ব্যাচ অবসরে গেছে।
ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (HAL) দেশে ১৮০টি উন্নত এমকে-১এ তেজস সরবরাহের অর্ডার পেয়েছে। কিন্তু জিই অ্যারোস্পেসের ইঞ্জিন সরবরাহে দেরির কারণে এখনও ডেলিভারি শুরু করা সম্ভব হয়নি।
HAL-এর সাবেক কর্মকর্তা একেবারে স্পষ্টভাবে বলেন, “দুবাইয়ের দুর্ঘটনা এখনই রপ্তানির পথ বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের অগ্রাধিকার হবে এখন তেজসকে দেশীয়ভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা।”
ভারতীয় বিমান বাহিনীর উদ্বেগ
ভারতের বিমান বাহিনীর বর্তমান স্কোয়াড্রন সংখ্যা ৪২ থেকে কমে ২৯-এ নেমে এসেছে। মিগ-২৯, জাগুয়ার ও মিরাজ-২০০০ এর মতো পুরোনো মডেলের ফাইটার জেটগুলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অবসরে যাবে। তেজস এই পুরোনো ফাইটার জেটগুলোর স্থান নেবার কথা ছিল, কিন্তু উৎপাদন ও সরবরাহে বিলম্ব তা বাধাগ্রস্ত করছে।
তাত্ক্ষণিক ঘাটতি মেটাতে ভারত ফ্রান্স থেকে অতিরিক্ত রাফায়েল ফাইটার জেট কিনতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ ও রাশিয়ার এস-৫৭ কেনার প্রস্তাবও বিবেচনা করছে।
জিই ইঞ্জিননির্ভর প্রযুক্তি
তেজস প্রকল্প মূলত জিই ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীল। ভারতের স্বদেশী ইঞ্জিন তৈরির প্রচেষ্টা এখনও সীমিত, তাই বিদেশি ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীলতা প্রকল্পকে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তবে দীর্ঘমেয়াদে, এই প্রকল্প ভারতের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতার ভিত্তি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ও ইঞ্জিন উন্নয়নে সমস্যার কারণে প্রকল্পটি দীর্ঘদিন বিলম্বিত হয়েছে। তবে এর বড় তাৎপর্য হতে পারে ভবিষ্যতের ভারতীয় যুদ্ধবিমান তৈরির জন্য শক্তিশালী শিল্প ও প্রযুক্তিগত ভিত্তি স্থাপন করা।
দুবাই শোতে ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা
দুবাই এয়ারশোতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেরই বড় উপস্থিতি ছিল। তেজস পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের সামনে আকাশে বিভিন্ন কসরত প্রদর্শন করেছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ঘোষণা করে যে তারা চীনের সহায়তায় তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-৩ যুদ্ধবিমান প্রাথমিকভাবে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশে সরবরাহ করবে। প্রদর্শনীতে জেএফ-১৭ এর পাশে রাখা ছিল চীনা পিএল-১৫ই ক্ষেপণাস্ত্র। মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে অন্তত একটি ভারতীয় রাফায়েল জেট ভূপাতিত করতে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল।
পাকিস্তানের বিমান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পিএসি জেএফ-১৭ কে ‘যুদ্ধে পরীক্ষিত’ হিসেবে প্রচার করে। ভারত বিষয়টি নিয়ে সতর্ক এবং জানিয়েছে, সংঘাতের সময় তেজস ব্যবহার করা হয়নি।
এছাড়া, চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনে তেজস অংশ নেয়নি। প্রধান কারণ ছিল নিরাপত্তা সংক্রান্ত। এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট হওয়ায় সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে নয়াদিল্লি তেজসকে প্রদর্শনী থেকে সরিয়ে রেখেছিল।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
ভারত তেজসকে কেবল একটি যুদ্ধবিমান হিসেবে নয়, বরং স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রতীক হিসেবে দেখেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২৩ সালের নভেম্বরে তেজসের উড্ডয়ন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
দুবাই এয়ারশোতে এই দুর্ঘটনার মাধ্যমে ভারতকে নিজস্ব উৎপাদন, রপ্তানি সম্ভাবনা ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের বিষয়গুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদিও এই দুর্ঘটনা স্বল্পমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, দীর্ঘমেয়াদে তেজস প্রকল্প ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
MAH – 13938 I Signalbd.com



