ভারত সরকার বাসমতী চাল ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের চাল রপ্তানিতে নতুন শর্ত আরোপ করেছে। এবার থেকে নন-বাসমতী চাল রপ্তানি করতে চাইলে ব্যবসায়ীদের অবশ্যই কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (APEDA)-এর সাথে নিবন্ধন করতে হবে।
গতকাল, বুধবার ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য দপ্তর (DGFT) এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, APEDA-র অনুমোদন ছাড়া কোনো নন-বাসমতী চাল বিদেশে রপ্তানি করা যাবে না।
বাংলাদেশ ভারতের নন-বাসমতী বা সাধারণ চালের অন্যতম বড় ক্রেতা দেশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ছয় লাখ টন চাল আমদানি করার অনুমোদন দেয়, যার বড় অংশ এসেছে ভারতের বাজার থেকে।
ভারতের নতুন শর্তের প্রভাব
ভারতের এই নতুন শর্তের কারণে চাল আমদানিতে অশুল্ক বাধা সৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে বাংলাদেশের বাজারে নন-বাসমতী চালের সরবরাহ ও দাম প্রভাবিত হতে পারে।
বাংলাদেশ শুধু ভারতের কাছ থেকে নয়, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য দেশ থেকেও চাল আমদানি করে থাকে। কিন্তু ভারত হল সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী। তাই ভারতের নতুন নিয়ম বাংলাদেশে সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানি অনুমোদনের জটিলতা ও নতুন শর্ত চাল ব্যবসায়ীদের জন্য সময় ও খরচ বাড়াবে। এর ফলে আমদানিতে বিলম্ব, দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, এবং বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
ভারতের চাল মজুত ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে
এই নতুন শর্ত এমন সময়ে এসেছে যখন ভারতের চাল মজুত রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ভারতের সরকারি গুদামে চালের মজুত গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। একই সময়ে গমের মজুতও গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মজুত বাড়ানো ভারতের উদ্দেশ্য হলো দাম নিয়ন্ত্রণ করা ও অভ্যন্তরীণ বাজারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় চাল সরবরাহ কিছুটা সীমিত হতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে চলমান বাধা
ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, এবং কিছু পণ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর ফলে এই পণ্যগুলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সরাসরি পাঠানো সম্ভব নয়।
তবে, সমুদ্রপথে ভারতের মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর ব্যবহার করে এসব পণ্য রপ্তানি করা যাবে।
নির্দিষ্টভাবে, নতুনভাবে নিষিদ্ধ নয় এমন নয়, বরং ৯ ধরনের পণ্য স্থলপথে রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো হলো:
- ফ্ল্যাক্স সুতা বর্জ্য
- কাঁচা পাট
- পাটের রোল
- ফ্ল্যাক্স সুতা
- পাটের সুতা
- ফুড গ্রেড সুতা
- লিনেন কাপড়
- লিনেন ও তুলার সুতা মিশ্রিত কাপড়
- কম প্রক্রিয়াজাত বোনা কাপড়
এই পণ্যসমূহ সমুদ্রপথে রপ্তানি করতে হবে, যা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য সময় ও খরচ বাড়াতে পারে।
বিশ্ব বাজারে ভারতের চালের প্রভাব
ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ। ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল-আগস্ট সময়ে ভারত প্রায় ৪৭০ কোটি ডলারের চাল রপ্তানি করেছে। এই সময় ভারতের চাল রপ্তানিতে ৬.৪% প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বিশ্ববাজারে চালের দাম প্রায় ৪০% নির্ভর করে ভারতের রপ্তানি নীতি ও সরবরাহের ওপর। তাই ভারতের নতুন শর্ত আন্তর্জাতিক বাজারে নন-বাসমতী চালের দাম ও সরবরাহকে প্রভাবিত করতে পারে।
ভারতের পূর্ববর্তী নীতি ও বাজারের প্রভাব
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত বাসমতী ছাড়া অন্যান্য চালের রপ্তানির ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
নিষেধাজ্ঞা উঠানোর পর ভারতের চাল রপ্তানিকারকরা সন্তুষ্ট হয়েছিল। তাঁরা এটিকে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মূলত, ভারতের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রভাব কমানোর কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এর ফলে, বিশ্ববাজারে চালের দাম কমতে শুরু করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) জানিয়েছে, ২০২৫ সালে সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩% কমেছে, যা আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে।
তবে, ভারতের এই নতুন শর্তের কারণে আবার আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সরবরাহ সীমিত হয়ে দাম বৃদ্ধি পেতে পারে, যা বাংলাদেশের মতো চাল আমদানি নির্ভর দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশ ভারতের নন-বাসমতী চালের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। দেশের খাদ্য সরবরাহ ও বাজারে চালের দাম ভারতের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন নিয়মের কারণে:
- আমদানিতে সময় বৃদ্ধি পেতে পারে।
- চালের দাম বৃদ্ধি হতে পারে।
- কিছু ক্ষেত্রে বাজারে সরবরাহে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
তবে বাংলাদেশ পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকা থেকে বিকল্প উৎস খুঁজে নতুনভাবে আমদানির চেষ্টা করতে পারে। এতে কিছুটা চাপ কমানো সম্ভব, তবে ভারতের প্রভাব কমবে না।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য নেয়া এক বাস্তব পদক্ষেপ। তবে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ সীমিত করবে, বিশেষত নন-বাসমতী চালের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা নতুন APEDA নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দ্রুত সমন্বয় করতে হবে। এতে তারা রপ্তানির ক্ষেত্রে বিলম্ব ও অতিরিক্ত খরচ এড়াতে পারবেন।
ভারতের নতুন নীতি বিশ্বের চাল বাজারে নতুন ধাক্কা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশসহ নন-বাসমতী চালের আমদানির ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। এ অবস্থায়:
- ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা জরুরি।
- বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজে নেয়া প্রয়োজন।
- বাজার পর্যবেক্ষণ ও দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের এই পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ বাজার রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য নেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও অন্যান্য আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য এটি চ্যালেঞ্জ ও নতুন কৌশল নির্ধারণের সময়।
MAH – 13007 I Signalbd.com



