ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ঘোষণা করা যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইলি বাহিনীর হামলা কমেনি; বরং নতুন করে বেড়েছে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর গত এক মাসে ২৬০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৬৩২ জন মানুষ। এই হামলার কারণে গাজার সংকট আরও কঠিন হয়ে উঠেছে এবং মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
ইসরাইলের হামলা অব্যাহত: উত্তরের তিন শহরে নতুন বিমান হামলা
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ভোর থেকে গাজা উপত্যকার উত্তরের বেইত লাহিয়া, গাজা সিটির পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস শহরে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। স্থানীয় সূত্র বলছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ছাড়াই বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে, ফলে বেসামরিক মানুষের হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যুদ্ধবিরতির পরও গত এক মাসে ইসরাইলি বাহিনীর পরিকল্পিত হামলাগুলো ছিল অত্যন্ত বিধ্বংসী। বিশেষ করে বেইত লাহিয়া ও গাজা সিটিতে বহু বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্র লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ: যুদ্ধবিরতি ‘কাগজে’, বাস্তবে চলছে যুদ্ধ
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান—
“যুদ্ধবিরতি নামক কাগজে লেখা চুক্তি বাস্তবে কার্যকর হয়নি। প্রতিদিনই নতুন নতুন মরদেহ হাসপাতালগুলোতে আনা হচ্ছে।”
তাদের দাবি, আহতদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। সীমিত ওষুধ, চিকিৎসাকর্মীর অভাব ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতালের কারণে স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা প্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
পশ্চিমতীরেও সহিংসতা: বাড়ছে শিশু হত্যার ঘটনা
অধিকৃত পশ্চিমতীরেও ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান থেমে নেই। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো শহরে হামলা, গুলিবর্ষণ এবং ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটছে।
- হেবরনের উত্তরাঞ্চলের বেইত উমর শহরে ইসরাইলি সৈন্যদের গুলিতে কয়েকজন শিশুর মৃত্যু হয়েছে—এ তথ্য নিশ্চিত করেছে স্থানীয় ফিলিস্তিনি প্রশাসন।
- আনতাবা শহরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরাইলি বাহিনীর সংঘর্ষ হয়, যেখানে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
- জেরুজালেমে দখলদার বাহিনীর ঘটনাবহুল অভিযানের সময় গুলিতে আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, পশ্চিমতীরের বিভিন্ন গ্রামে মধ্যরাতের পরও অভিযান ও গ্রেপ্তার অভিযান চলছে এবং অনেক সময়ই সাংবাদিক, চিকিৎসক ও ত্রাণকর্মীদের উপরেও হামলা করা হচ্ছে।
হামাস আরও এক জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করেছে
ইসরাইলের আগ্রাসনের মধ্যেও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস গাজা উপত্যকা থেকে আরও এক ইসরাইলি জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করেছে। হামাস জানায়—
“আমরা জিম্মিদের মুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি, তবে ইসরাইলের আগ্রাসী অবস্থান এ প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছে।”
ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা এখনো গাজায় বহু জিম্মিকে খুঁজে পাচ্ছে না এবং এটি ইসরাইলি সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে ইসরাইলজুড়ে চলছে বিক্ষোভ, যা নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে।
মানবিক বিপর্যয়ের হুমকি: শীতের ঝড়ে আশ্রয়হীন মানুষের জীবন ঝুঁকিতে
গাজায় শুধু যুদ্ধ নয়—বন্যা, শীতের ঝড় এবং পর্যাপ্ত আশ্রয়ের অভাবে আসছে আরও বড় মানবিক বিপর্যয়। রাফা শহরের ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছে—
“হাজার হাজার মানুষ তাঁবু ও ধ্বংসস্তূপে আশ্রয় নিয়ে আছে। শীতের ঝড় আসায় তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।”
বর্তমানে গাজায় প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। তাদের বেশিরভাগই প্লাস্টিকের অস্থায়ী তাঁবু, আধা-ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন বা স্কুলে আশ্রয় নিয়ে আছে। শীতের রাতে তাপমাত্রা কমে যায় ৮–১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বৃষ্টি হলে এসব তাঁবু ও ভেঙে যাওয়া ঘর দ্রুত পানি জমে যায়, ফলে শিশুদের মধ্যে ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী:
- গাজায় প্রতিদিন গড়ে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
- ম্যালেরিয়া, হামের মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
- স্থানীয় হাসপাতালে মোট মেডিকেল সিস্টেমের ৭৫% কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: যুদ্ধবিরতি মানছে না ইসরাইল
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজার পরিস্থিতিকে “বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটগুলোর একটি” বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য—
“যুদ্ধবিরতি চলাকালে যে হামলা অব্যাহত থাকে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। গাজা একটি ‘শিশুদের কবরস্থানে’ পরিণত হচ্ছে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশও ইসরাইলের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন অস্ত্র সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে—যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
গাজার সাধারণ মানুষের কথা: পানি, খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট
যুদ্ধবিরতি থাকা সত্ত্বেও গাজায় ত্রাণ প্রবেশ সীমিত। রাফা সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ৩০–৪০টি ট্রাক ঢুকলেও এটি বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
মানুষ বলছে:
- পরিষ্কার পানি পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে।
- এক পরিবারে ৮–১০ জনের জন্য প্রতিদিন একটির বেশি রুটি পাওয়া যায় না।
- ওষুধের অভাবে সাধারণ জ্বর থেকেও শিশুরা মারা যাচ্ছে।
গাজার এক বাসিন্দা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন—
“গোলাগুলি হয়তো একটু কমেছে, কিন্তু ক্ষুধা ও রোগে আমরা মারা যাচ্ছি বেশি। যুদ্ধবিরতি বলে কিছু নেই।”
ইসরাইলের যুক্তি: ‘হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে’
ইসরাইলি সরকার বলছে, হামাসের সামরিক কাঠামো ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের অভিযান চালিয়ে যাবে। ইসরাইল দাবি করছে—
- হামাস এখনো সীমান্ত টানেলের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে,
- গাজায় অনেক জায়গায় ‘গোপন ঘাঁটি’ রয়েছে,
- জিম্মিদের একটি অংশকে হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়ে রেখেছে।
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইলের হামলার ৯০% লক্ষ্যই বেসামরিক এলাকা। অধিকাংশ নিহতই সাধারণ মানুষ—যা ইসরাইলের ‘সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড’ তত্ত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আবারও বাড়ছে
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত নাজুক:
- লেবাননের হিজবুল্লাহ সীমান্তে ইসরাইলের সঙ্গে নিয়মিত সংঘর্ষে লিপ্ত।
- ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠী ইসরাইলমুখী জাহাজে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে।
- ইরান–ইসরাইল সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
বৈশ্বিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হয় এবং হামলা কমানো না হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
শিশুদের সবচেয়ে বড় শিকার: গাজায় জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত
ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজায় নিহতদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু। যারা বেঁচে আছে, তারা স্থায়ী মানসিক আঘাত নিয়ে বড় হচ্ছে।
তারা বলেছে—
“এই শিশুরা রাতের পর রাত বোমার শব্দে ঘুমায়, মৃতদেহ দেখে বড় হয়। একটি পুরো প্রজন্মকে আমরা হারিয়ে ফেলছি।”
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, গাজার শিশুদের অনেকেই এখন ‘ট্রমাটিক স্ট্রেস সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত। কেউ কেউ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ কেউ রাতভর কাঁদে।
গাজার নারী ও মায়ের আর্তনাদ: ‘আমাদের সন্তানদের আর কত কবর দেব?’
গাজায় হাজার হাজার নারী এখন সন্তানদের ক্ষুধা, ঠান্ডা, রোগ ও গোলাগুলি থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
এক মা বলেন—
“যুদ্ধবিরতি বলে কিছু নেই। প্রতিদিনই আমরা কারও না কারও লাশ কবর দিচ্ছি।”
যুদ্ধবিরতির ছায়াতেও মৃত্যু—গাজা এখনো রক্তাক্ত
গাজায় যুদ্ধবিরতির পরও ২৬০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬৩২ জন আহত হওয়া প্রমাণ করে, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ভেতর এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অঞ্চলটি।
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান ও জাতিসংঘের সীমিত ভূমিকা গাজাকে আসলে মুক্তি দিচ্ছে না।
মানুষ সেখানে শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে—খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, নিরাপত্তা—সব কিছুর জন্য।
MAH – 13814 I Signalbd.com



