ভারতের সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবারও ঘৃণা উসকে দেওয়ার মতো বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন দশনা দেবী মন্দিরের প্রধান ও পরিচিত হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যতী নরসিংহানন্দ গিরি। তিনি ভারতের চারটি সুপ্রাচীন ও বিশ্বখ্যাত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—দারুল উলুম দেওবন্দ, জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া, আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়—ধ্বংস করার জন্য সরাসরি সামরিক হামলার আহ্বান জানিয়েছেন।
মুসলিম মিররের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, দিল্লিতে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের ঘটনায় মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি এসব প্রতিষ্ঠানকে “সন্ত্রাসীদের আস্তানা” আখ্যা দেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কামান দাগিয়ে এগুলো উড়িয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন। তার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর মুসলিম সমাজসহ ভারতজুড়ে নিন্দা ঝড় উঠেছে।
ভিডিওটিতে তাকে বলতে শোনা যায়— “আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়, এএমইউ, জামিয়া মিল্লিয়া ও দারুল উলুম দেওবন্দের মতো সন্ত্রাসীদের আস্তানাগুলোকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কামান দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া উচিত।” তিনি আরও দাবি করেন, “এটা আমার জীবনের শেষ পর্যায়। তোমরা তোমাদের নেতাদের চাপ দাও, যেন তারা কামান দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে। নাহলে বিলুপ্তির ঝুঁকি নাও।”
এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের সর্বত্র উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন উন্মুক্ত উসকানি শুধু সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাই বাড়ায় না, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতার মৌলিক নীতিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়।
ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন টার্গেটে?
যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের আহ্বান জানানো হয়েছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই উপমহাদেশের শিক্ষাঙ্গনের গর্ব। তাদের অতীত, অবদান এবং বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষেপে:
১. দারুল উলুম দেওবন্দ
১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ভারতবর্ষের ইসলামি শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেওবন্দের আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
২. জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া
১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে জন্ম নেয়। মহাত্মা গান্ধীসহ তৎকালীন অনেক নেতা এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বর্তমানে এটি ভারতের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (AMU)
১৮৭৫ সালে স্যার সাইদ আহমদ খানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত আলিগড় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রতি বছর হাজারো শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশ থেকে এসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে।
৪. আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়
তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষায় দ্রুত অগ্রগতি দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক দিল্লি বিস্ফোরণের ঘটনার পর এখানকার ৩ জন ডাক্তারকে সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হলেও এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
এই চারটি প্রতিষ্ঠান ভারতের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলার দাবি অভূতপূর্ব এবং ভয়ংকর নজির।
দিল্লি বিস্ফোরণ ও সাম্প্রতিক উত্তেজনা
১০ নভেম্বর দিল্লির লাল কেল্লায় বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হন। ঘটনাটি তদন্তাধীন হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়—এইসব উসকানিমূলক বক্তব্য সাধারণ জনতার অ্যাকাউন্ট থেকে নয়; বরং নীল-টিকযুক্ত, জনপ্রিয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অ্যাকাউন্ট থেকেই প্রকাশ্যে আসছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, তদন্ত শেষ না করেই কোনো গোষ্ঠীকে দোষারোপ করা কিংবা প্রতিশোধ নিতে উন্মুক্ত আহ্বান জানানো ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় অপরাধ। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে খুব কম ক্ষেত্রেই এই উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রভাব
এই ধরনের বক্তব্য সীমান্তবর্তী দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের মন্তব্য। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাংলাদেশের সামাজিক প্ল্যাটফর্মেও প্রভাব ফেলতে পারে। সে কারণে এই ধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্য দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
উগ্রপন্থী বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধর্মীয় নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। অনেকেই বলছেন—
- এটি রাষ্ট্র ও সমাজকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দাবি সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক।
- সরকারের উচিত অবিলম্বে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
ভারতের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এই ধরনের উসকানিতে প্ররোচিত না হয়ে আইনের ওপর আস্থা রাখাই এখন একমাত্র পথ।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা গ্রহণের অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কিন্তু কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার আহ্বান মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত নয়। আইনের ভাষায় এটি ঘৃণা ছড়ানো ও সহিংসতায় প্ররোচনা—যা জেল-জরিমানাযোগ্য অপরাধ।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- এমন উসকানি দেশদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়তে পারে।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সমতুল্য।
- রাষ্ট্রের উচিত দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
ভবিষ্যতে কী?
বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের সামাজিক সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদি উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- সরকারকে নিন্দার পাশাপাশি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।
- ঘৃণাবিদ্বেষমূলক বক্তব্য দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি।
- শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
MAH – 13813 I Signalbd.com



