বিশ্ব

ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লায় সীমা না রাখার ঘোষণা ইরানের

Advertisement

তেহরানের ঘোষণা, প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় আর কোনও সীমাবদ্ধতা নয়; পশ্চিমাদের চাপকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বলছে ইরান

ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির পাল্লায় আর কোনো সীমা থাকবে না। দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) জানিয়েছে, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় ইরান এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বাহ্যিক চাপ বা নির্দেশনা মেনে চলার কোনো প্রয়োজন নেই। এই ঘোষণাকে তেহরানের সামরিক কৌশলে এক বড় মোড় পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে সীমা প্রত্যাহারের ঘোষণা

ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর উপপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি ফাদাভি বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) তেহরানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সবসময়ই উন্নতির পথে রয়েছে, এবং এর পাল্লা সীমিত রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

তিনি আরও বলেন, আইআরজিসি একটি গতিশীল ও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর সংস্থা, যা দেশের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। “আমরা নিজেদের সীমা নিজেরাই নির্ধারণ করি, অন্য কারও নির্দেশে নয়,”—যোগ করেন ফাদাভি।

ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা মেহের জানায়, ফাদাভি ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লা সীমিত রাখার বিষয়টি ‘অ-বিশেষজ্ঞ ও অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে, “যারা ইরানের সামরিক সক্ষমতা বোঝে না, তারাই এসব অবান্তর দাবি তোলে।”

পূর্বে ছিল ২২০০ কিলোমিটারের সীমা

ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য আহমেদ বখশায়েশ আরদেস্তানি এক বিবৃতিতে জানান, আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পূর্বে ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লা ২২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আঞ্চলিক হুমকি বৃদ্ধির কারণে সেই সীমা এখন তুলে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি যতটা প্রয়োজন মনে করবে, ততটাই উন্নত করবে। কারণ আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি অন্য কারও নির্দেশে পরিচালিত হয় না।”

এ ঘোষণার ফলে তেহরান এখন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিল, দেশটি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা নির্ধারণে আর কোনো বাহ্যিক নির্দেশ বা আন্তর্জাতিক সীমাবদ্ধতা মানবে না।

কেন এই সিদ্ধান্ত এখন

বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সিরিয়া ও লেবাননে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর ধারাবাহিক হামলার জবাবে তেহরান তার প্রতিরক্ষা নীতিতে নতুন করে জোর দিচ্ছে।

গত জুনে ইসরাইলি বাহিনীর সঙ্গে তেহরান-সমর্থিত সংগঠনগুলোর সংঘর্ষের পর ইরানের সামরিক কমান্ডে পরিবর্তন আসে। এরপর থেকেই ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।

তেহরানের ধারণা, “আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ” দেশগুলো কৃত্রিমভাবে ইরানের ওপর চাপ তৈরি করছে। সেই প্রেক্ষিতে ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লায় আর কোনো সীমা না রাখার এই সিদ্ধান্ত মূলত একপ্রকার প্রতিরোধমূলক বার্তা।

পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

ইরানের এ সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ওয়াশিংটন বলছে, ইরানের নতুন পদক্ষেপ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

ইরান অবশ্য এসব সমালোচনাকে “অপ্রাসঙ্গিক” বলে উড়িয়ে দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়। এটি কেবল ইরানের প্রতিরক্ষার অংশ। পশ্চিমারা সবসময় আমাদের প্রতিরক্ষা উদ্যোগকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে।”

আরাঘচি আরও অভিযোগ করেন, ইসরাইল মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বলছে যে তেহরান গোপনে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। “এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যেই প্রচার করা হচ্ছে,”— বলেন তিনি।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিশ্ব প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রধারী রাষ্ট্র। দেশটির হাতে ২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লার কয়েক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা সহজেই ইসরাইল, সৌদি আরব, এবং মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানতে সক্ষম।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান তাদের “খোররামশাহ”, “সাজিল” এবং “এমাদ” নামের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর উন্নত সংস্করণ তৈরি করেছে। এখন নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩,০০০–৫,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

ফাদাভি বলেন, “আমাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা কেবল আজকের নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরা কারও অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকব না।”

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে ইরানের নতুন বার্তা

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের এই ঘোষণা মূলত একটি কৌশলগত বার্তা — শুধু ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্য।

তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে ইরান চায় তার সামরিক শক্তিকে “অপ্রতিরোধ্য” হিসেবে উপস্থাপন করতে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট ইরানকে শান্তিচুক্তি আলোচনায় ফিরিয়ে আনতে চাইলেও তেহরান এখন কঠোর অবস্থানে।

তেহরানের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লা সীমা তুলে নেওয়া মানে ইরান এখন আরও স্বাধীনভাবে তার সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়ন করতে পারবে, বিশেষ করে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও প্রতিরক্ষা মহাকাশ কর্মসূচিতে।

আঞ্চলিক ভারসাম্যে নতুন অধ্যায়

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লায় সীমা না রাখার ঘোষণা কেবল একটি সামরিক নীতি নয়, বরং আঞ্চলিক ভারসাম্যের নতুন সূচনা। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এর প্রভাব গভীর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সিদ্ধান্ত কি ইরানের নিরাপত্তা আরও জোরদার করবে, নাকি নতুন সংঘাতের জন্ম দেবে?
বিশ্লেষকদের মতে, উত্তরটি নির্ভর করছে এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতি কতটা কার্যকর হয় তার ওপর।

এম আর এম – ২২২২,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button