গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ইসরায়েলি বাহিনীর টানা হামলায় পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। যুদ্ধবিরতির মাঝেও নতুন এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে ‘ইয়েলো লাইন’ বা হলুদ রেখা। এই রেখার আশপাশে প্রতিদিনই গুলি, বোমা হামলা ও সংঘর্ষে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। আন্তর্জাতিক মহল যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে চাপ দিলেও, ইসরায়েলি সেনারা এই সীমারেখা অতিক্রমের অভিযোগে নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি।
ইয়েলো লাইন: গাজার নতুন মৃত্যুফাঁদ
ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী ও হামাসের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যবর্তী একটি অস্থায়ী সীমারেখা হিসেবেই ‘ইয়েলো লাইন’ নির্ধারণ করা হয়েছিল। মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই লাইন তৈরি হয়, যা হামাস ও ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে পৃথক করার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর থেকেই এই সীমারেখা গাজাবাসীর জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিনই এই রেখার আশপাশে সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ ও বিমান হামলায় হতাহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। স্থানীয় সূত্র জানায়, ইসরায়েলি সেনারা সন্দেহভাজন হামাস যোদ্ধা ধরার অজুহাতে সাধারণ মানুষকেও লক্ষ্যবস্তু করছে।
প্রতিদিনের হামলায় বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলমান যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও গত এক মাসে ইয়েলো লাইন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে অন্তত ২৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও হাজারো মানুষ। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলো এখন ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে আছে। প্রায় ১৬ হাজার মানুষ জরুরি চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত চার হাজার শিশু। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অভাব চরম আকার ধারণ করেছে।
ইসরায়েলের দাবি: নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণই লক্ষ্য
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাদাভ শোশানি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ধ্বংস নয়, বরং হামাসের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করা।” তাঁর দাবি, ইয়েলো লাইন সংলগ্ন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সুড়ঙ্গের মুখ, রকেট লঞ্চার কিংবা অস্ত্রের মজুত ছিল। সেই কারণেই ওই এলাকাগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরায়েলি সেনারা ‘নিরাপত্তা অভিযান’ নামের আড়ালে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করছে, যার ফলে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বলছে, যুদ্ধবিরতির পরও এমন হামলা স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন।
মিশর-তুরস্কের মধ্যস্থতায় নতুন শান্তি উদ্যোগ
চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্রিয় হয়েছে মিশর ও তুরস্ক। দুই দেশ যৌথভাবে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়ন ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা করছে। মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা গাজায় শান্তি বজায় রাখতে জাতিসংঘ ও আরব লীগের সঙ্গে সমন্বয় করছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টও আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানিয়েছেন, “গাজার মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন মানবতার দায়িত্ব।”
গাজা এখন এক ধ্বংসস্তূপের নগরী
একসময় প্রাণবন্ত গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বেইত হানুন থেকে গাজা সিটি পর্যন্ত ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে কেবল ধূসর ধ্বংসাবশেষ। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র এক মাসের মধ্যে দেড় হাজারেরও বেশি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে গাজার কিছু দখলকৃত এলাকা সীমিতভাবে দেখার অনুমতি দিয়েছে। তবে সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, সবকিছুই ছিল ইসরায়েলি সামরিক সেন্সরের নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও দেওয়া হয়নি।
একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেন, “যা আমরা দেখেছি, তা গাজার বাস্তব চিত্রের এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। শহরের মূল অংশগুলো যেন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেছে।”
হামাসের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
হামাসের দাবি, যুদ্ধবিরতি চুক্তি বারবার ভাঙছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের অভিযোগ, প্রতিদিনই ইয়েলো লাইন বরাবর বেসামরিকদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, তারা হামাসের অস্ত্রধারীদের প্রতিহত করছে মাত্র।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের এক খসড়া প্রস্তাবে গাজার নিরাপত্তা ও পুনর্গঠনের জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবে। তবে প্রস্তাবটি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
গাজাবাসীর অসহায় বাস্তবতা
গাজার এক বাসিন্দা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা জানি না কোথায় নিরাপদ। ইয়েলো লাইনের কাছে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত, আর ঘরেও নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিনই নতুন বোমা, নতুন হামলা।”
গাজার বহু পরিবার এখনো ধ্বংসস্তূপে নিখোঁজ আপনজনদের খুঁজছে। শিশুদের মুখে খাবার নেই, পানির সংকট তীব্র, হাসপাতালের অবস্থা করুণ। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও গাজার মানুষের জীবনে শান্তি ফেরেনি।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার বর্তমান সংকট কেবল সামরিক নয়, এটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকেও যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ইসরায়েলি অভিযান থামার কোনো ইঙ্গিত নেই। একদিকে শান্তির আহ্বান, অন্যদিকে গোলাগুলির শব্দ — এই দুইয়ের মাঝখানে দমবন্ধ করে বেঁচে আছে গাজাবাসী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইয়েলো লাইন এখন কেবল একটি সীমানা নয়, এটি গাজাবাসীর প্রতিদিনের ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। শান্তি চুক্তি কার্যকর না হলে এই সীমারেখা আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠবে।
গাজার আকাশে যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি ভেসে বেড়ালেও মাটিতে তার ছোঁয়া মেলেনি। ‘ইয়েলো লাইন’ এখন ফিলিস্তিনিদের কাছে কেবল একটি মানচিত্রের রেখা নয়, বরং এক অনন্ত আতঙ্কের নাম। মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন প্রশ্ন তুলছে — এই রক্তপাতের শেষ কোথায়?
এম আর এম – ২২২১,Signalbd.com



