বিশ্ব

ক্যারিবিয়ানে হামলার অজুহাত সাজাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

Advertisement

ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সম্ভাব্য সামরিক আক্রমণের পথ সুগম করতে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে “মিথ্যা নাটক” সাজাচ্ছে— এমন অভিযোগ তুলেছেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো।
বুধবার (১২ নভেম্বর ২০২৫) রাতে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের আগে যেভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে যুদ্ধের অজুহাত তৈরি করা হয়েছিল, আজ আবার সেই একই কৌশল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে।”

মাদুরোর অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সামরিক কার্যক্রম ও তথ্যযুদ্ধ একটি “পরিকল্পিত প্রচেষ্টা”, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভেনেজুয়েলা ও অন্যান্য ক্যারিবিয়ান দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করা।

‘ইরাক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে’

তার বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট মাদুরো ইরাক যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আমেরিকা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার পরিণতি আজও মধ্যপ্রাচ্য বহন করছে। এখন তারা আবার সেই একই কৌশল ব্যবহার করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে চাইছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশে কোনো পারমাণবিক বা ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নেই। তবু তারা ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য, ভুয়া ভিডিও ও গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে— যাতে আক্রমণের অজুহাত তৈরি করা যায়। এমনকি আমেরিকার নিজস্ব নাগরিকরাও এখন এই গল্পগুলো বিশ্বাস করছে না।”

ক্যারিবিয়ান সাগরে নতুন উত্তেজনা

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্টের এই অভিযোগ এমন এক সময় এসেছে, যখন ক্যারিবিয়ান সাগরে মার্কিন সামরিক কার্যক্রম দ্রুত বেড়ে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ও ড্রোন সেখানে টহল দিচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

গত মঙ্গলবার ক্যারিবিয়ান সাগরে এক মার্কিন হামলায় অন্তত ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক জলসীমায় মার্কিন সামরিক অভিযানে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৫ জনে। ভেনেজুয়েলা ও কিউবা দাবি করছে, এসব হামলা “অবৈধ” এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।

আমেরিকার নীরবতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত মাদুরোর অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ওয়াশিংটন টাইমস এবং রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর (পেন্টাগন) সাম্প্রতিক সামরিক কার্যক্রমকে “আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার অংশ” বলে উল্লেখ করেছে।

জাতিসংঘের কয়েকজন কূটনীতিক জানান, ভেনেজুয়েলা বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে তুলতে পারে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কিউবা, নিকারাগুয়া ও বলিভিয়ার পক্ষ থেকে মাদুরোর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। কিউবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি শুধু ভেনেজুয়েলার নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।”

ভেনেজুয়েলা-আমেরিকা সম্পর্ক: এক দশকের টানাপোড়েন

গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার কূটনৈতিক সম্পর্ক বহুবার সংকটে পড়েছে। ২০১৯ সালে নিকোলাস মাদুরো পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সরকারকে “অবৈধ” ঘোষণা করে বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে সমর্থন দেয়।

এরপর থেকেই ভেনেজুয়েলার ওপর একাধিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর সম্পদ জব্দ করা হয়, এমনকি ব্যাংক লেনদেনেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এসব নিষেধাজ্ঞায় ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মাদুরো এসব পদক্ষেপকে “অর্থনৈতিক যুদ্ধ” বলে অভিহিত করেছেন এবং দাবি করেছেন, আমেরিকার লক্ষ্য হচ্ছে ভেনেজুয়েলাকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করা ও সরকার পরিবর্তনের পথ তৈরি করা।

ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব

ক্যারিবিয়ান সাগর দীর্ঘদিন ধরেই ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানকার ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ, জ্বালানি রুট ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য কৌশলগত অবস্থান দখল করে আছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব। ভেনেজুয়েলা ও কিউবা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা ওয়াশিংটনের কাছে উদ্বেগের বিষয়।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. জন রবার্টস বলেন, “ভেনেজুয়েলা শুধু তেলসম্পদ নয়, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণেও যুক্তরাষ্ট্রের নজরে রয়েছে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে আমেরিকা আসলে চীন ও রাশিয়াকে বার্তা দিচ্ছে— তারা এখনো পশ্চিম গোলার্ধের নিয়ন্ত্রক।”

ভেনেজুয়েলার জনগণের প্রতিক্রিয়া

মাদুরোর বক্তব্যের পর রাজধানী কারাকাসে সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ করে। তারা “আমাদের ভূখণ্ড রক্ষা করো” ও “বিদেশি আগ্রাসন বন্ধ করো” লেখা ব্যানার হাতে র‌্যালি করে।

একজন বিক্ষোভকারী বলেন, “আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে কেউ খেলতে পারবে না।”

অন্যদিকে, দেশটির বিরোধী দলগুলো মাদুরোর বক্তব্যকে “রাজনৈতিক কৌশল” বলে দাবি করেছে। তাদের অভিযোগ, অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি থেকে জনগণের মনোযোগ সরাতেই সরকার এমন বক্তব্য দিচ্ছে।

বিশ্লেষণ: নতুন শীতল যুদ্ধের ইঙ্গিত?

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার বর্তমান টানাপোড়েন শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নয়— বরং এটি একটি “নতুন শীতল যুদ্ধের” লক্ষণ।
রাশিয়া ও চীন এখন ভেনেজুয়েলার প্রধান সহযোগী দেশ। সামরিক সরঞ্জাম, তেল বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় তারা সক্রিয়ভাবে ভেনেজুয়েলাকে সমর্থন দিচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা বাড়ানো কেবল একটি ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং লাতিন আমেরিকায় তাদের হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাও হতে পারে।

নিকোলাস মাদুরোর অভিযোগ শুধু একটি বক্তব্য নয়— এটি বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতির একটি গভীর ইঙ্গিত। যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে, তখন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও নতুন এক উত্তেজনার ছায়া ঘনিয়ে আসছে।

ভেনেজুয়েলার এই অভিযোগের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কী প্রতিক্রিয়া জানায়, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী পদক্ষেপ নেয়— তা এখন সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট: লাতিন আমেরিকার আকাশে আবারও পুরনো সংঘাতের মেঘ জমতে শুরু করেছে।

ভেনেজুয়েলা ও যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব শুধু দুটি দেশের বিষয় নয়; এটি বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এই অঞ্চলের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে— যা হয়তো ভবিষ্যতের নতুন এক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা করবে।

MAH – 13785 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button