পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে জেলা ও দায়রা আদালতের বাইরে ভয়াবহ আত্মঘাতী বিস্ফোরণে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৭ জন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুর ১২টার কিছু পর ইসলামাবাদের জি-১১ এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে।
পুলিশ ও প্রশাসনের ধারণা, হামলাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
হামলার ঘটনাস্থলে বিশৃঙ্খলার চিত্র
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, আত্মঘাতী হামলাকারী আদালত ভবনের প্রবেশপথে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। নিরাপত্তা বাহিনী বাধা দিলে সে আদালতের বাইরে থাকা একটি পুলিশ গাড়ির পাশে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলে আগুন ধরে যায়, এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, আদালত ভবনের আশপাশে গাড়ি ও মোটরসাইকেল আগুনে জ্বলছে, আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই প্রবল ছিল যে আশপাশের ভবনগুলো কেঁপে ওঠে।
সরকারের বক্তব্য ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নিহত ও আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসা সেবা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ব্যক্তিগতভাবে পরিস্থিতির তদারকি করছেন এবং ইসলামাবাদের হাসপাতালগুলোকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,
“এটি সাধারণ কোনো হামলা নয়। রাজধানীর হৃদয়ে এমন একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে, যা স্পষ্টতই দেশের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার চেষ্টা। আমরা হামলাকারীর পরিচয় ও পেছনের গোষ্ঠী সম্পর্কে তদন্ত করছি, কেউ দায় এড়িয়ে যেতে পারবে না।”
রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
বিস্ফোরণের সময় আদালতের ভেতরে থাকা আইনজীবী রুস্তম মালিক বলেন, “আমি গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ প্রবল শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সবাই আতঙ্কে দৌড়াতে থাকে। গেটের পাশে দুটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি এবং চারপাশে আগুন জ্বলছিল।”
তিনি আরও বলেন, “পুরো এলাকা বিশৃঙ্খলায় ভরে যায়। আইনজীবী, কর্মচারী, সাধারণ মানুষ— সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটে যায়।”
এখনো দায় স্বীকার করেনি কোনো সংগঠন
এ পর্যন্ত কোনো জঙ্গি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, সম্প্রতি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এই হামলার যোগ থাকতে পারে। ইসলামাবাদে গত কয়েক মাসে এ ধরনের হামলা না ঘটলেও সীমান্তবর্তী এলাকায় টেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সক্রিয় ছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকভি জানিয়েছেন, “হামলাকারী প্রায় ১২ মিনিট আদালতের বাইরে ঘোরাফেরা করেছিল। সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বিশ্লেষণ করে আমরা হামলাকারীর পরিচয় উদঘাটনে কাজ করছি।”
নিরাপত্তা জোরদার ও তদন্ত কার্যক্রম
ঘটনার পরপরই ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকা ঘিরে ফেলে নিরাপত্তা বাহিনী। সেনাবাহিনী, রেঞ্জার্স ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান শুরু করেছে। আদালত কমপ্লেক্সের আশপাশে সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তদন্তকারীরা ঘটনাস্থল থেকে বিস্ফোরকের নমুনা সংগ্রহ করেছেন, যাতে জানা যায় কী ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল।
পুলিশ প্রধান আকবর হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাটি আত্মঘাতী ছিল। তবে এতে আর কেউ সম্পৃক্ত ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি
গত কয়েক মাসে পাকিস্তানে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে জঙ্গি হামলা ও বিস্ফোরণের ঘটনা। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একাধিক হামলা হয়েছে। ইসলামাবাদে এমন বড় হামলা দীর্ঘদিন পর ঘটল, যা দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগান সীমান্তের অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। সরকারের জন্য এটি বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
ইসলামাবাদের বিস্ফোরণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। জাতিসংঘের মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে।”
ভারত, বাংলাদেশ, ও আফগানিস্তান থেকেও শোক ও সমবেদনা জানানো হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ইসলামাবাদে বিদেশি দূতাবাসগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. ইমরান কাসেম বলেন, “রাজধানীতে এই ধরনের আত্মঘাতী হামলা প্রমাণ করে, পাকিস্তানে জঙ্গি নেটওয়ার্ক এখনও সক্রিয়। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “এটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজধানীতে হামলা মানে বার্তা দেওয়া যে, তারা যেকোনো সময় আঘাত হানতে সক্ষম।”
সম্ভাব্য প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
এই হামলার পর ইসলামাবাদের নিরাপত্তা সতর্কতা আরও জোরদার করা হয়েছে। আদালত, সরকারি অফিস এবং বিদেশি দূতাবাসগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনার ফলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অস্থির হতে পারে। সরকার যদি দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের বিচার নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে এমন হামলার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে।
ইসলামাবাদের এই আত্মঘাতী হামলা পাকিস্তানের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা। রাজধানীর মতো উচ্চনিরাপত্তা এলাকায় এমন ঘটনা প্রমাণ করে, সন্ত্রাসবাদ এখনো দেশটির অভ্যন্তরে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত তদন্ত ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই সন্ত্রাসী তৎপরতা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এম আর এম – ২১৮৪,Signalbd.com



