ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেট সোমবার এক ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিল পাস করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন থেকে ইসরাইলের সরকার ফিলিস্তিনি বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে—যা দেশটিতে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক পক্ষপাতের নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
বিলটি পাস হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এ বিলের কঠোর সমালোচনা করেছে।
বিলটি কী বলে?
ইসরাইলের ইহুদি শক্তি (Jewish Power) দলের নেতা ও দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির এই বিলটি উত্থাপন করেন। বিল অনুযায়ী, যদি কোনো ফিলিস্তিনি ইসরাইলি নাগরিককে ‘ঘৃণা বা ইচ্ছাকৃত ক্ষতির উদ্দেশ্যে’ হত্যা করে, তবে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে।
নেসেটের অধিবেশনে ১২০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩৯ জন বিলটির পক্ষে ভোট দেন এবং ১৬ জন বিপক্ষে যান। বাকি সদস্যরা অনুপস্থিত বা ভোটদানে বিরত থাকেন। প্রাথমিক পাঠে পাস হওয়ার পর বিলটি এখন চূড়ান্ত যাচাই ও অনুমোদনের জন্য সংসদের এক বিশেষ কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
নেসেটে উত্তপ্ত পরিস্থিতি
বিলের আলোচনা চলাকালীন পার্লামেন্টে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আরব আইনপ্রণেতা আয়মান ওদেহ বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বেন-গাভিরের বক্তব্যের জবাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয় যে, তা প্রায় শারীরিক সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌঁছায় বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়।
বেন-গাভির পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন,
“আজ ইসরাইলের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। যারা আমাদের নাগরিকদের রক্ত ঝরিয়েছে, তারা আর রেহাই পাবে না।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র নিন্দা
বিলটি পাসের পরপরই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর কঠোর সমালোচনা করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং স্থানীয় ইসরাইলি মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো একযোগে বলেছে,
“এই আইনটি মূলত ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এটি ইসরাইলের দীর্ঘদিনের বৈষম্যমূলক নীতিকে আরও বৈধতা দেবে।”
তারা আরও যুক্তি দিয়েছে, ইসরাইলের বিচারব্যবস্থা আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, এবং এই নতুন আইন সেই বৈষম্যকে আইনগত কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত করবে।
ইতিহাসে দ্বিতীয়বার মৃত্যুদণ্ডের পথে ইসরাইল
১৯৬২ সালের পর এটাই হবে ইসরাইলের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন। প্রথমবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল নাৎসি যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইখম্যানকে—যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ ইহুদির হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। এরপর থেকে ইসরাইল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেনি।
তবে নতুন এই বিল কার্যকর হলে, এবার ফিলিস্তিনি বন্দিদের ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে—যা অনেকের মতে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করবে মধ্যপ্রাচ্যে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আইন পাসের মাধ্যমে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার জোট সরকারের ডানপন্থী অংশকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। নেতানিয়াহুর সরকার বর্তমানে কঠোর ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ, যারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে।
ইসরাইলের সাবেক মানবাধিকার কমিশনার মাইকেল বেন-ডোর বলেন,
“এটি কেবল একটি আইন নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা। ইসরাইল তার নিরাপত্তা ও জাতীয়তাবাদী অবস্থানকে আরও জোরালো করতে চাইছে, এমনকি যদি তার মানে হয় মানবাধিকারের সীমা লঙ্ঘন।”
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হানান আশরাউই এক বিবৃতিতে বলেন,
“ইসরাইল এই আইন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ভয় দেখাতে চায়। এটি মূলত একধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধনীতি, যা আরও রক্তপাত ডেকে আনবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিলটি পাস হওয়ার পর জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ (UNHRC) উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি কখনোই শান্তি ও ন্যায়বিচারের সমাধান নয়। তারা ইসরাইলকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
**ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)**ও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“ইসরাইলের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকারের পরিপন্থী, এবং এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা কূটনৈতিক ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে এবং মানবাধিকার নীতির প্রতি তাদের অঙ্গীকার অটুট থাকবে।
ফিলিস্তিনে ক্ষোভ ও শোক
এই বিল পাসের পর পশ্চিম তীর, গাজা ও জেরুজালেমে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ফিলিস্তিনি নাগরিকরা রাস্তায় নেমে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন। গাজা শহরের এক বিক্ষোভকারী বলেন,
“ইসরাইল আমাদের কণ্ঠরোধ করতে চায়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে আমাদের দমানো যাবে না।”
ফিলিস্তিনি প্রশাসনের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনা বিলটিকে “মানবতার পরিপন্থী আইন” বলে অভিহিত করে বলেন,
“ইসরাইল এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। আমরা এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
বিলের পেছনে রাজনীতি
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে পড়েছেন। দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি থাকা নেতানিয়াহু সরকার এখন কঠোর ডানপন্থীদের সমর্থন ধরে রাখতে মরিয়া। তাই এই মৃত্যুদণ্ড বিল তার রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার এক কৌশল হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
এক ইসরাইলি সংবাদপত্র হারেৎজ মন্তব্য করেছে,
“নেতানিয়াহু সরকারের জন্য এটি কেবল ন্যায়বিচারের বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিক টিকে থাকার লড়াই।”
মানবাধিকার বনাম জাতীয় নিরাপত্তা
ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, তাদের কঠোর নিরাপত্তা নীতির কারণ হলো সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই অজুহাতে ফিলিস্তিনিদের উপর অন্যায়, হত্যা ও আটক অভিযান চালানো হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন।
ইসরাইলের এক শান্তিকর্মী সংগঠন বেটসেলেম বলেছে,
“যদি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তা হলে ইসরাইল কার্যত বিচারবহির্ভূত হত্যাকে বৈধতা দেবে।”
আগামী পথ
বিলটি এখন নেসেটের একটি বিশেষ কমিটিতে চূড়ান্ত যাচাইয়ের অপেক্ষায়। সব ধাপ সম্পন্ন হলে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে। তখন ইসরাইলের আদালতগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আইন কার্যকর হলেও তা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সম্পর্ককে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাবে, এবং নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়াবে।
ইসরাইলের পার্লামেন্টে পাস হওয়া ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুদণ্ড বিলটি কেবল একটি আইন নয়—এটি মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের সংঘাত, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিচ্ছবি। মানবাধিকারকর্মী ও আন্তর্জাতিক মহল যেখানে শান্তি ও সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে, সেখানে ইসরাইলের এই পদক্ষেপ যেন সেই আশা ধ্বংসের আরেকটি অধ্যায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
MAH – 13750 I Signalbd.com



