ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হাসান আল-মাদানী বলেছেন, ইসরায়েল যদি গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করে, তাহলে ইয়েমেনি বাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাবে এবং সামরিক অভিযান আবার শুরু করবে। তিনি হামাসের যোদ্ধাদের উদ্দেশে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, “আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রাখব এবং যেকোনো মূল্যে তোমাদের সঙ্গে থাকব।” এই বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
মূল প্রতিবেদন
রোববার, ৯ নভেম্বর ২০২৫—ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হাসান আল-মাদানী এক উষ্ণ ও দৃঢ় ভাষায় হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডের যোদ্ধাদের উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠান। তিনি বলেন, “যদি শত্রুরা গাজায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করে, আমরা ফের যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরব। আমরা আমাদের অঙ্গীকার রাখব এবং যেকোনো মূল্যে তোমাদের পাশে থাকব।”
এই ঘোষণা শুধু একটি বিবৃতি নয়, বরং এটি ইয়েমেনের সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তভাবে তুলে ধরে। গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং হামাসের সঙ্গে ইয়েমেনি বাহিনীর এই প্রকাশ্য সংহতি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে নাড়া দিয়েছে।
গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে তীব্র সংঘাত শুরু হয়। সেই সময় থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে হৌতি গোষ্ঠী, সরব হয়ে ওঠে। ইয়েমেনের হৌতিদের পক্ষ থেকে বলা হয়—তারা ফিলিস্তিনের প্রতি মুসলিম বিশ্বের নৈতিক ও সামরিক দায়িত্ব পালন করবে।
এর পর থেকেই লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোর ওপর হামলার ঘটনাও বেড়ে যায়। ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনী কয়েকবারই তেলবাহী জাহাজ ও কার্গো জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে আন্তর্জাতিক মহল জানিয়েছে। যদিও ইয়েমেনি পক্ষ দাবি করে, এসব আক্রমণ ছিল ফিলিস্তিনিদের প্রতি নৃশংস হামলার প্রতিবাদ হিসেবে।
ইউসুফ হাসান আল-মাদানীর ভূমিকা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হাসান আল-মাদানী বর্তমানে ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। তিনি শুধু সামরিক কমান্ডারই নন, বরং রাজনৈতিক অবস্থানেও দৃঢ় একজন কৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত। হামাসের যোদ্ধাদের উদ্দেশে তার সাম্প্রতিক বার্তাটি ইঙ্গিত দেয় যে, ইয়েমেনি বাহিনী এখন শুধু প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং কৌশলগতভাবে নিজেদের প্রস্তুত রাখছে।
তার বক্তব্যে তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যেতে ভয় পাই না। ফিলিস্তিন আমাদের ভাই, আর তাদের নিরাপত্তা আমাদের দায়িত্ব। ইসরায়েল যদি আবার গাজা ধ্বংসের চেষ্টা করে, আমরা চুপ করে থাকব না।”
লোহিত সাগরে সামরিক উত্তেজনা
২০২৩ সাল থেকে ইয়েমেনের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে লোহিত সাগরের জাহাজ চলাচলে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলার বেশিরভাগের দায় স্বীকার করে ইয়েমেনের হৌতি আন্দোলন। তারা দাবি করে, এসব অভিযান ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে।
লোহিত সাগর হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট। এই পথে প্রতিদিন শত শত জাহাজ চলাচল করে। ইয়েমেনি হামলার ফলে অনেক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা তাদের নৌযাত্রা স্থগিত করে বা বিকল্প রুট ব্যবহার শুরু করে। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইয়েমেনের এই অবস্থান ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক নৌপরিবহনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। এতে করে শুধু ইসরায়েল নয়, বিশ্ববাণিজ্যেরও ক্ষতি হবে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ও ইয়েমেনের অবস্থান
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্বে ইয়েমেন সবসময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে হৌতি গোষ্ঠী, যারা বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ক্ষমতা ধরে রেখেছে, তারা প্রকাশ্যে হামাসের সমর্থন জানিয়েছে। তাদের মতে, “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে মুসলিম বিশ্বের অস্তিত্ব রক্ষা করা।”
বছরের পর বছর যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে থাকা ইয়েমেন এখনো সামরিক প্রস্তুতি বজায় রেখেছে। যদিও দেশটি নিজেই একটি জটিল গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে, তবুও তারা বারবার আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইয়েমেনি সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এই বক্তব্যকে “সংঘাত বৃদ্ধির আশঙ্কা” হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে, কিছু ইসলামি রাষ্ট্র ইয়েমেনের সাহসী অবস্থানকে “ন্যায়বিচারের আওয়াজ” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইতোমধ্যে রেড সি অঞ্চলে তাদের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা—ইয়েমেনি হামলা বৃদ্ধি পেলে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউসুফ হাসান আল-মাদানীর এই ঘোষণা একদিকে হামাসের প্রতি সমর্থনের বার্তা হলেও অন্যদিকে এটি ইয়েমেনের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করারও একটি কৌশল। তারা দেখাতে চাইছে—যদিও ইয়েমেন বহু বছর ধরে নিজস্ব গৃহযুদ্ধে জর্জরিত, তবুও তারা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করার সামর্থ্য রাখে।
এই অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি ভারসাম্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সৌদি আরব, ইরান, মিশরসহ অন্যান্য দেশও এখন নতুনভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে।
সম্ভাব্য পরিণতি
১. নৌবাণিজ্যে প্রভাব: যদি ইয়েমেন আবার সামরিক অভিযান শুরু করে, তাহলে লোহিত সাগর ও সুযেজ খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনে।
২. সংঘাতের বিস্তার: গাজা যুদ্ধ যদি ইয়েমেনের অংশগ্রহণে পুনরায় তীব্র হয়, তাহলে এটি শুধু ইসরায়েল ও হামাস নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
৩. মানবিক বিপর্যয়: যুদ্ধের আগুন আবার ছড়িয়ে পড়লে ইয়েমেন ও ফিলিস্তিন উভয় দেশেই মানবিক সংকট আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে লাখো মানুষ খাদ্য ও চিকিৎসা সঙ্কটে ভুগছে।
৪. আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ: জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন আরও তৎপর হবে। কারণ, এই সংঘাত শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত।
ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি
ইয়েমেন বর্তমানে নিজ দেশের গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যের চাপে ন্যুব্জ। রাজধানী সানায় হৌতি গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকলেও দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে সরকারি বাহিনী এবং সৌদি-সমর্থিত মিলিশিয়া সক্রিয় রয়েছে। এই অবস্থায় বিদেশি সামরিক পদক্ষেপ তাদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি।
তবুও ইয়েমেনি নেতৃত্ব মনে করে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ থাকলে তাদের অস্তিত্বের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হবে। তাই তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হামাসের প্রতি সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করে চলেছে।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব
বিশ্ব অর্থনীতিতে লোহিত সাগরের গুরুত্ব অপরিসীম। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্যের মূল পথ হিসেবে এই অঞ্চল ব্যবহৃত হয়। ইয়েমেন যদি পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করে, তাহলে জ্বালানি পরিবহন ব্যাহত হতে পারে এবং তেলের দাম আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে।
এছাড়া রেড সি অঞ্চলে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে আন্তর্জাতিক সামরিক শক্তিগুলোর উপস্থিতি আরও বাড়বে, যা কূটনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। ইতিমধ্যে কিছু ইউরোপীয় দেশ তাদের বাণিজ্যিক নৌবহরকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দিয়েছে।
ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হাসান আল-মাদানীর এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায় উন্মোচন করেছে। ইসরায়েল যদি গাজায় পুনরায় আক্রমণ চালায়, তাহলে ইয়েমেন যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে প্রস্তুত—এমন বার্তা স্পষ্টভাবে পুরো বিশ্বকে জানানো হয়েছে।
এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় সতর্ক সংকেত। কারণ, এ ধরনের পদক্ষেপ পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ও ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইয়েমেনের অবস্থান অনেকের কাছে সাহসী মনে হলেও, বিশ্বশক্তিগুলোর কাছে এটি এক ধরনের নতুন চ্যালেঞ্জ। আসন্ন দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোন পথে মোড় নেয়—তা এখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বজুড়ে নজর কাড়বে।
MAH – 13735 I Signalbd.com



