গাজায় আটকে আছে জাতিসংঘের ৫ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক, ইসরায়েলের কড়াকড়িতে স্থবির মানবিক সহায়তা কার্যক্রম
গাজায় ত্রাণ কার্যক্রমে বড় বাধা
গাজায় ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্যেই জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ গুরুতর বাধার মুখে পড়েছে। ইসরায়েলের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে সংস্থাটির প্রায় ৫,০০০ ত্রাণবাহী ট্রাক সীমান্তে আটকে আছে। ফলে গাজায় খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সংস্থাটির গাজা কার্যক্রমের সিনিয়র উপপরিচালক জন হোয়াইট জানান, ইসরায়েল এখন ইউএনআরডাব্লিউএ–এর নিজস্ব ত্রাণসামগ্রী গাজায় প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের নির্দেশ দিয়েছে এসব সামগ্রী অন্য সংস্থার মাধ্যমে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি সব প্যাকেজ থেকে ইউএনআরডাব্লিউএ–এর লোগো মুছে ফেলতে বলা হয়েছে, যা সংস্থাটির কার্যক্রমে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার আইনি পটভূমি
ইসরায়েল গত বছর সংসদে একটি আইন পাস করে, যেখানে ইউএনআরডাব্লিউএ–এর কার্যক্রম দেশটিতে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এর পর থেকে গাজায় সরাসরি ত্রাণ কার্যক্রম চালানো বন্ধ হয়ে যায় জাতিসংঘের এই সংস্থার।
ইসরায়েল দাবি করছে, ইউএনআরডাব্লিউএ–এর কিছু কর্মী হামাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই তাদের ত্রাণ তৎপরতা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে জাতিসংঘ এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে, ইসরায়েলের এমন নিষেধাজ্ঞা মানবিক সংকট আরও গভীর করবে।
গাজায় ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি
বর্তমানে গাজায় প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বসবাস করছে, যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ এখন খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসেবে, গাজার অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
এ অঞ্চলে হাসপাতালগুলোতে জ্বালানি ঘাটতির কারণে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক স্থানে ওষুধের অভাবে সাধারণ রোগের চিকিৎসাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের সরবরাহ করা চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য ও পানিশোধন যন্ত্র সীমান্তে আটকে আছে।
জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের উদ্বেগ
ইউএনআরডাব্লিউএ–এর মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইসরায়েলের এ ধরনের বাধা শুধু ত্রাণ কার্যক্রমকেই নয়, বরং গাজার সাধারণ জনগণের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে আসন্ন শীতে হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধা ও অসুস্থতায় মারা যেতে পারে।”
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (OCHA) বলেছে, “আমরা যে সহায়তা নিয়ে যেতে চাই তা পুরোপুরি মানবিক। ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।”
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, কানাডা এবং আরব লিগ এই নিষেধাজ্ঞাকে “মানবিকতার পরিপন্থী” বলে নিন্দা জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “যখন একটি জনগোষ্ঠী মানবিক বিপর্যয়ের মুখে, তখন ত্রাণ আটকে রাখা কোনোভাবেই ন্যায্য নয়।”
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে “বোঝার যোগ্য” বললেও, মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
গাজার সাধারণ মানুষের অসহায় জীবন
গাজার স্থানীয় সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবীরা জানাচ্ছেন, সীমান্তে খাদ্য ও ওষুধ আটকে থাকায় শহরজুড়ে এখন তীব্র সংকট। রুটি, দুধ, ওষুধ এমনকি পানিও বিরল হয়ে উঠেছে।
একজন গাজাবাসী নারী বলেন, “আমাদের শিশুরা তিন দিন ধরে ঠিকমতো খেতে পারেনি। আমরা জানি না, কাল কী খাবো। ত্রাণ ছাড়া বাঁচার কোনো উপায় নেই।”
এমন পরিস্থিতিতে গাজাবাসীর একমাত্র আশা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো। কিন্তু ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা সেই আশা দিন দিন ম্লান করে দিচ্ছে।
পরিসংখ্যান ও মানবিক ক্ষতির চিত্র
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ১২ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। অবকাঠামো বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে।
গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি এতটাই প্রকট যে, অনেক চিকিৎসক বাধ্য হয়ে পুরোনো ব্যান্ডেজ পুনঃব্যবহার করছেন। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় অন্তত ১৮ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের এই নিষেধাজ্ঞা আসলে গাজায় জাতিসংঘের প্রভাব কমানোর একটি কৌশল। ইউএনআরডাব্লিউএ দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছে, যা ইসরায়েলের কাছে অস্বস্তিকর।
তবে আন্তর্জাতিক আইনজীবীরা মনে করেন, মানবিক সহায়তা আটকে দেওয়া যুদ্ধাপরাধের শামিল হতে পারে। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞায় জাতিসংঘের ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো সীমান্তে পড়ে থাকা শুধু একটি প্রশাসনিক জটিলতা নয়, এটি গাজার মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন। ত্রাণ পৌঁছাতে না পারলে আগামী সপ্তাহগুলোতে গাজায় মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই যদি আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি না করা হয়, তবে এই অবরোধ মানবতার বিরুদ্ধে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করবে।
এম আর এম – ২১৬৬,Signalbd.com



