জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একের পর এক বিশ্বনেতা গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন। মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবে উপত্যকার মাটিতে রক্ত ঝরছে অব্যাহতভাবে। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণ।
জাতিসংঘে উদ্বেগ, কিন্তু বাস্তবে আগ্রাসন
সর্বশেষ অধিবেশনে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আরব লীগ—সবার মুখেই যুদ্ধবিরতির কথা। কিন্তু এরই মধ্যে গাজায় ইসরাইলি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে আরও অন্তত ৮৫ জনকে হত্যা করেছে। নিহতদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র।
শরণার্থী শিবিরে ভয়াবহ হামলা
ইসরাইলি হামলার অন্যতম লক্ষ্য হয়েছে গাজার শরণার্থী শিবিরগুলো। বুধবার রাতে একাধিক সুউচ্চ ভবনে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। গাজার নগর কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে দখলদার বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। স্থানীয়রা বলছেন, পানি নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই—এমন পরিস্থিতিতে শিশুরা একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
মানবিক সংকট ও অনিশ্চয়তা
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। খাদ্য ও ওষুধের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ নেই, ফলে আহতদের চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তবে পুরো উপত্যকা মানবিক বিপর্যয়ের গভীর খাদে পড়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও প্রস্তাব
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত একটি যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা আরব দেশগুলোর সামনে তুলে ধরেছেন। এতে বন্দি বিনিময়, ধাপে ধাপে সেনা প্রত্যাহার, গাজায় নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলাসহ মোট ২১টি ধারা রয়েছে। আরব দেশগুলো প্রস্তাবের বেশিরভাগ পয়েন্টে সম্মত হলেও শর্ত হিসেবে যোগ করেছে—পশ্চিম তীর দখল না করা, জেরুজালেমের বর্তমান অবস্থা বজায় রাখা এবং দ্রুত হামলা বন্ধ করা।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরাইলেই বিক্ষোভ
অন্যদিকে, ইসরাইলের মধ্যেই সরকারবিরোধী প্রতিবাদ তীব্র আকার নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হন। শত শত মানুষ তার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধের’ অভিযোগ তুলে গাজায় হামলা বন্ধের দাবি জানায়। বিশ্লেষকদের মতে, এই অভ্যন্তরীণ চাপ নেতানিয়াহুর অবস্থানকে আরও কঠিন করে তুলছে।
হুতি বিদ্রোহীদের পাল্টা হামলা
গাজার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাত শহরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এর মধ্যে একটি ড্রোন আটকাতে ব্যর্থ হয়। এতে কয়েকজন আহত হন। হুতিদের মুখপাত্র ঘোষণা করেছেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘে যতই আলোচনার ঝড় উঠুক না কেন, বাস্তবে যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হয়, তবে এসব আলোচনা অর্থহীন থেকে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী যদি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্বনেতাদের হাঁকডাক হয়তো কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু বাস্তবে গাজার মানুষের চোখে সেই প্রচেষ্টা এখনো অকার্যকর। একদিকে যুদ্ধবিরতির ডাক, অন্যদিকে অব্যাহত হত্যাযজ্ঞ—এই বৈপরীত্যের মাঝেই মানবতার সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছে। সামনে কী হবে, তা নির্ভর করছে বিশ্বশক্তিগুলোর বাস্তব পদক্ষেপের ওপর।
এম আর এম – ১৫১৬,Signalbd.com



