পাকিস্তান এবং ইরান একযোগে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন একটি কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। শুক্রবার (৭ নভেম্বর) ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাগের গালিবাফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেন, “পাকিস্তান এবং ইরান উভয়ই আমাদের অঞ্চলে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা পারস্পরিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী।”
বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
ইরানি স্পিকার মোহাম্মদ বাগের গালিবাফের ইসলামাবাদ সফরটি কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার লক্ষ্য নিয়ে এসেছে। সফরের তৃতীয় দিনে শুক্রবার সকালে তিনি পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই নেতা উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, বাণিজ্যিক সহযোগিতা, এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকের শেষে গালিবাফ পাকিস্তানি নেতাকে একটি বিশেষ চিত্রকর্ম উপহার দেন, যেখানে লেখা ছিল “পাকিস্তান ও ইরানের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক”।
শাহবাজ শরিফ বলেন, “আমরা চাই আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হোক। পাকিস্তান ও ইরান উভয়ই শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অঞ্চলের জন্য একসাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” তিনি আরও বলেন, দুই দেশ বিশ্বজুড়ে চলমান বিরোধ নিরসনের জন্য কূটনৈতিক সংলাপের গুরুত্ব বাড়াতে চাইছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক
পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের জন্য বিশেষ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। পাকিস্তানি অর্থমন্ত্রী এবং ইরানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে দুই দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনিয়োগ, এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস প্রজেক্টে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির ওপর আলোচনা শুরু করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করলে না শুধু উভয় দেশের অর্থনীতিকে লাভ হবে, বরং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও শক্তি দেবে। পাকিস্তানের প্রধান বাণিজ্য বিশ্লেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “দুটি দেশের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হতে পারে।”
কূটনীতি ও মুসলিম ঐক্যের গুরুত্ব
ইরান এবং পাকিস্তান উভয়ই মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও শান্তি বৃদ্ধির জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করছে। বিশেষভাবে, আফগানিস্তান, সিরিয়া, এবং ইয়েমেনে চলমান সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য দুই দেশ কূটনৈতিক সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
শাহবাজ শরিফ বলেন, “আমরা চাই শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে সমস্ত আন্তর্জাতিক বিরোধ নিরসন হোক। মুসলিম দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী ঐক্য তৈরি করা আমাদের লক্ষ্য।”
ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার গালিবাফও এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেন, “ইরান এবং পাকিস্তান শুধু নিজেদের স্বার্থের জন্য নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য একযোগে কাজ করবে। আমরা চাই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি হোক।”
পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত নিরাপত্তা
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। পাকিস্তান ও ইরানের সীমান্তে চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদ এবং মাদক পাচারের মতো সমস্যা সমাধানের জন্য যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দুই দেশ সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি, সাইবার নিরাপত্তা এবং আইনি সহায়তা প্রদান নিয়ে কাজ করছে।
সীমান্ত নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগ কেবল সন্ত্রাসবাদ দমনেই নয়, সীমান্তে জনজীবন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আরও নিরাপদ করবে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব
বিশ্ব রাজনীতিতে পাকিস্তান-ইরান সংহতির প্রভাব ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই নতুন কূটনৈতিক সংহতি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা আনতে পারে।
বিশ্ব ব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, পর্যটন বৃদ্ধি, এবং শিল্প খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
পাকিস্তান এবং ইরান আগামী মাসে আরও উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকের পরিকল্পনা করছে। এই বৈঠকে দুই দেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এবং পরিবেশ সংরক্ষণে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরণের কূটনৈতিক সংহতি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
পাকিস্তান এবং ইরানের এই নতুন কূটনৈতিক সংহতি মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি আশার আলো। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করা, সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, সব মিলিয়ে এই উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শাহবাজ শরিফ এবং মোহাম্মদ বাগের গালিবাফের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-ইরান সম্পর্কের নতুন অধ্যায় মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
MAH – 13691 I Signalbd.com



