ওয়াশিংটনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন এক নাম— আহমেদ আল–শারা। একসময় যিনি যুক্তরাষ্ট্রের “মোস্ট ওয়ান্টেড” তালিকায় ছিলেন, সেই আল–শারা এখন সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রীয় সফরে পৌঁছেছেন মার্কিন রাজধানীতে। তাঁর এই সফর শুধু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নয়, বৈশ্বিক কূটনীতিতেও বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা এবং আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এই সফরকে যুক্তরাষ্ট্র এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছে—দামেস্ককে আইএসআইএল বা আইএসআইএস বিরোধী আন্তর্জাতিক জোটে যুক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ওয়াশিংটনে আল–শারার আগমন
শনিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে পৌঁছান আহমেদ আল–শারা। তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা গেছে, রোববার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে তাঁর বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
সফরের সময়সূচিতে আরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হবে—সিরিয়ার পুনর্গঠন, সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল।
সিরিয়ায় নিরাপত্তা অভিযান ও নতুন বার্তা
আল–শারার যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঠিক সময়েই সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, দেশজুড়ে আইএসআইএল সেলের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু হয়েছে। সরকারি সংবাদমাধ্যম সানা জানিয়েছে, আলেপ্পো, ইদলিব, হামা, হোমস ও দামেস্কের উপকণ্ঠে অন্তত ৬১টি অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে ৭১ জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
এই অভিযানকে “জাতীয় সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার অংশ” হিসেবে উল্লেখ করেছে সিরিয়ার সরকার। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আল–শারার মার্কিন সফরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত—ওয়াশিংটনের কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে এবং বৈশ্বিক জোটে যুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি প্রদর্শন করতে চাইছে দামেস্ক।
সিরিয়ার ইতিহাসে বিরল এক সফর
১৯৪৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এই প্রথম কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিক সফরে গেলেন। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার সম্পর্ক বরাবরই ছিল তিক্ত। বিশেষ করে বাশার আল–আসাদের সময় সিরিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার ও গৃহযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দামেস্কের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
কিন্তু আল–শারার উত্থানের পর দেশটির রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। তিনি বাশার আল–আসাদ সরকারের পতনের পর থেকে একটি অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনা করছেন, যা বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে সীমিত স্বীকৃতি পেয়েছে।
‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান: আল–শারার অতীত
আহমেদ আল–শারার অতীত অনেকটা চলচ্চিত্রের গল্পের মতো। একসময় তিনি ছিলেন আল–কায়েদার সিরিয়া শাখার একজন শীর্ষ নেতা। পরে তিনি ঐ গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস) নামে একটি সংগঠন গঠন করেন, যা পরবর্তীতে আইএসআইএলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, এবং তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করা হয় প্রায় এক কোটি ডলার। কিন্তু গত জুলাই মাসে ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে এইচটিএস–কে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দেয়।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ছিল পরিকল্পিত—সিরিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামোতে আল–শারাকে ব্যবহার করার কৌশল।
ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে আল–শারা
যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া–বিষয়ক বিশেষ দূত টম বারাক বলেছেন, “আশা করা যায়, আল–শারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগদানের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। এটি শুধু আইএসআইএস–এর বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বরং সিরিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও একটি নতুন অধ্যায়।”
রয়টার্স ও এএফপি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে একটি স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এই ঘাঁটি ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা চুক্তির অংশ হতে পারে। এমন পদক্ষেপকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সিরিয়ার পুনর্গঠন: বিশাল চ্যালেঞ্জ
১৩ বছরের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়া এখন এক বিপর্যস্ত দেশ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এবং অবকাঠামোর অর্ধেকের বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির পূর্ণ পুনর্গঠনে প্রয়োজন অন্তত ২১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। কিন্তু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
আল–শারা আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ার পুনর্গঠনে অংশ নেবে। তাঁর সফরের একটি বড় লক্ষ্যই হলো—অর্থনৈতিক সাহায্য ও বিনিয়োগ আহ্বান করা।
জাতিসংঘে ঐতিহাসিক উপস্থিতি
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আল–শারার উপস্থিতি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তিনি ছিলেন কয়েক দশক পর প্রথম সিরীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, “সিরিয়া শান্তি চায়, তবে মর্যাদার সঙ্গে।”
এই সফরের আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক প্রস্তাবে আল–শারার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপ তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরকে বাস্তবায়নযোগ্য করে তোলে।
বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আল–শারার এই সফর সিরিয়া–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এখন দামেস্ককে ঘিরে নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছে।
তবে সমালোচকরাও আছেন। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র একসময় যাকে সন্ত্রাসী বলত, এখন সেই ব্যক্তিকেই কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে—আল–শারার অতীত ভূমিকা ও তাঁর সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, “ওয়াশিংটনের জন্য এটি একটি জটিল কূটনৈতিক পরীক্ষা। তারা কি সত্যিই সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা চায়, নাকি নিজেদের স্বার্থেই নতুন খেলোয়াড়দের ব্যবহার করছে?”
আল–শারার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সূত্র জানিয়েছে, আল–শারা ওয়াশিংটনে অবস্থানকালে সিরিয়ার পুনর্গঠন ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে একাধিক সমঝোতা স্মারকে সই করবেন। পাশাপাশি তিনি মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করবেন, যেখানে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা হবে।
ওয়াশিংটনে অবস্থান শেষে তিনি প্যারিস ও লন্ডনে সফর করার সম্ভাবনাও রয়েছে, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
আহমেদ আল–শারার যুক্তরাষ্ট্র সফর শুধু দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক কূটনৈতিক ভারসাম্যেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
একসময় যিনি পশ্চিমাদের চোখে ছিলেন সন্ত্রাসী নেতা, আজ তিনি আলোচনার টেবিলে একজন রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর এই পরিবর্তন যেমন প্রশ্ন তোলে, তেমনি সম্ভাবনারও দ্বার খুলে দেয়—সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কি সত্যিই নতুন দিকের দিকে এগোচ্ছে, নাকি এটি কেবল আরেকটি কৌশলগত নাট্যাংশ?
যা–ই হোক না কেন, বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে দামেস্ক ও ওয়াশিংটনের দিকে—এই সফরই হয়তো নির্ধারণ করবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির পরবর্তী মানচিত্র।
MAH – 13686 I Signalbd.com



