বিশ্ব

তৃতীয় দফায়ও ব্যর্থ পাকিস্তান-আফগান শান্তি আলোচনা

Advertisement

ইস্তাম্বুলে ব্যর্থ হলো তৃতীয় দফার আলোচনাও

সীমান্ত উত্তেজনা ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিরসনে কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় তৃতীয় দফায় শান্তি আলোচনায় বসেছিল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকটি দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল।

কিন্তু, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলার পরও কোনো বাস্তব সমাধান পাওয়া যায়নি। আলোচনার শেষেই দুই দেশের প্রতিনিধি দল একে অপরের ওপর ব্যর্থতার দায় চাপায়। ফলে, বহুল প্রত্যাশিত এই বৈঠকও আগের দুই দফার মতোই ভেস্তে যায়।

শান্তির আশায় আলোচনায় বসে আরও রক্তপাত

আলোচনা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। আফগান সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাকিস্তানের দিক থেকে ছোড়া গোলাবর্ষণে আফগানিস্তানের কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন।

আফগান তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম পাকিস্তান বাস্তবসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় আসবে। কিন্তু তারা বরাবরের মতোই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছে।”

তিনি অভিযোগ করেন, “পাকিস্তান তাদের নিরাপত্তা দুর্বলতার সব দায় আফগান সরকারের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করেছে, অথচ নিজেদের ভূমিকার কোনো দায়িত্ব নিতে চায়নি।”

তালেবানের দাবি: আমরা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করিনি

শান্তি আলোচনায় ব্যর্থতার পর কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র মুজাহিদ স্পষ্টভাবে জানান, আফগানিস্তান যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেনি এবং তাদের বাহিনী সীমান্তে আত্মরক্ষার অবস্থানে রয়েছে।

তিনি বলেন, “তালেবান সরকার সবসময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে। কিন্তু আমাদের সীমান্তে আক্রমণ হলে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না। পাকিস্তান যদি সত্যিকারের শান্তি চায়, তাহলে পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখতে হবে।”

পাকিস্তানের বক্তব্য: আফগানিস্তান সহযোগিতা করছে না

অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। আলোচনার টেবিলে এখন একপ্রকার অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আমরা এই অবস্থায় কোনো আশার আলো দেখছি না।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা আফগানিস্তানের কাছ থেকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাস্তব সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছিলাম। প্রাথমিক আলোচনায় তারা সম্মতি দিলেও চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পিছিয়ে গেছে। এতে বোঝা যায়, তারা আন্তরিক নয়।”

ইসলামাবাদের কঠোর অবস্থান

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেন, “তালেবান সরকারের এমন কোনো সিদ্ধান্তকেই ইসলামাবাদ সমর্থন করবে না, যা আফগান জনগণ বা প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী।”

তারার আরও যোগ করেন, “আফগানিস্তান যদি সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়, তবে তা শুধু পাকিস্তানের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি।”

দোহা চুক্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ

পাকিস্তান দাবি করছে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া দোহা শান্তি চুক্তির প্রতিশ্রুতি তালেবান সরকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ওই চুক্তিতে তালেবানরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আফগান ভূখণ্ড কখনও অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না।

কিন্তু পাকিস্তানের মতে, তালেবানরা এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। বিশেষ করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী আফগানিস্তানের ভেতরে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একাধিক ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে।

এই হামলাগুলোর জেরে পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালাচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত করে তুলছে।

তালেবানের পাল্টা দাবি

তালেবান সরকার টিটিপি-কে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে। কাবুলের দাবি, পাকিস্তান নিজের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ দমন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, আর সেই দায় তারা আফগানিস্তানের ওপর চাপাচ্ছে।

তালেবান মুখপাত্ররা বারবার বলেছেন, আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো বিদেশি সন্ত্রাসী ঘাঁটি নেই। তবে পাকিস্তান এই বক্তব্যকে বিশ্বাস করছে না।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন: বেড়ে চলছে মানবিক সংকট

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অক্টোবরের শুরু থেকে সীমান্তে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তাতে অন্তত ৫০ জন আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত৪৪৭ জন আহত হয়েছেন।

অন্যদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, তালেবান বা টিটিপি হামলায় ২৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত২৯ জন আহত হয়েছেন। তবে, পাকিস্তান বেসামরিক হতাহতের বিষয়টি স্বীকার করেনি।

এই সংঘর্ষের ফলে সীমান্তের সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

কেন ব্যর্থ হলো এই আলোচনা

বিশ্লেষকদের মতে, তৃতীয় দফার আলোচনার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো— দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস। পাকিস্তান মনে করে, তালেবান আফগানিস্তান এখন টিটিপি-র অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, তালেবান মনে করে, পাকিস্তান তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে এবং আফগান সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে।

তাছাড়া, আফগানিস্তান এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ায় তাদের কূটনৈতিক অবস্থানও দুর্বল। ফলে তারা নিজেরাও চাপের মুখে রয়েছে।

কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আশার আলো ম্লান

এই বৈঠকে কাতার ও তুরস্কের প্রতিনিধি দল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করলেও, তারা দুই পক্ষকে সমঝোতার পথে আনতে ব্যর্থ হন।

তুরস্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, “দুই দেশই শান্তি চায়, কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা টেবিলে এসেছে। ফলে, কোনো অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।”

দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়ছে অস্থিরতা

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের এই অচলাবস্থা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ইতোমধ্যেই সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলা, বাণিজ্য স্থগিত, এবং মানবিক সংকট পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাতিসংঘ— তিন পক্ষই এই সংঘাত দ্রুত নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাস্তবিকভাবে শান্তি স্থাপনে দুই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

শান্তি এখনো দূরের স্বপ্ন

তৃতীয় দফার আলোচনার ব্যর্থতা পাকিস্তান-আফগান সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। সীমান্তে সংঘর্ষ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

দুই দেশের জনগণ ক্লান্ত যুদ্ধ, হত্যা ও অভাব-অনটনে। তারা শান্তি চায়, স্থিতিশীলতা চায়। কিন্তু রাজনৈতিক অবিশ্বাস, অভ্যন্তরীণ সংকট ও সন্ত্রাসবাদের ছায়া সেই শান্তির পথ রুদ্ধ করে রেখেছে।

বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে— চতুর্থ দফার আলোচনায় কি কোনো সমাধানের আলো দেখা যাবে, নাকি সীমান্তের এই রক্তক্ষয়ী অধ্যায় আরও দীর্ঘ হবে?

MAH – 13678 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button