দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী আবারও রক্তাক্ত করল পশ্চিম তীর। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আল-জুদেইরা গ্রামে অভিযান চালিয়ে দুই ফিলিস্তিনি যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি, তবে স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তারা উভয়েই গ্রামের তরুণ কৃষক ছিলেন এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (Twitter)–এ একটি ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেছে, নিহতরা নাকি একটি সড়কের পাশে টহলরত সেনাদের দিকে মলোটভ ককটেল (পেট্রোল বোমা) নিক্ষেপ করেছিল। তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দারা এই দাবি অস্বীকার করেছেন। তাদের ভাষায়, ইসরায়েলি বাহিনী কোনো উসকানি ছাড়াই গ্রামে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলি চালায়।
স্থানীয়দের বর্ণনায় ভয়াবহ রাত
আল-জুদেইরা গ্রামের বাসিন্দা হামজা ইউসুফ বলেন,
“রাত তখন প্রায় দুইটা। হঠাৎই আমরা গুলির শব্দ শুনতে পাই। সেনারা বাড়িঘরে ঢুকে তল্লাশি চালায় এবং দুই যুবককে রাস্তার পাশে গুলি করে ফেলে রাখে। তাদের সাহায্য করতে গেলে আমরাও বাধাপ্রাপ্ত হই।”
গ্রামের প্রবীণ মুনির সাঈদ বলেন,
“ইসরায়েলি বাহিনী এখন প্রতিদিনই কোনো না কোনো অজুহাতে পশ্চিম তীরে হামলা চালাচ্ছে। যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ঘরবাড়ি ভাঙছে, আর প্রতিরোধ করলে গুলি করছে।”
সেনাবাহিনীর দাবি বনাম বাস্তবতা
ইসরায়েলি সেনারা বলেছে, নিহত দুজন ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত’ ছিলেন এবং তারা টহলরত বাহিনীর দিকে আগুনের বোতল নিক্ষেপ করেছিলেন। তবে কোনো স্বতন্ত্র সূত্র বা ভিডিও প্রমাণে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং, ঘটনাস্থল থেকে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোতে দেখা যায়, দুজনের শরীরে গুলির চিহ্ন স্পষ্ট, কিন্তু কোনো অস্ত্র বা বিস্ফোরক বস্তু পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থা B’Tselem জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে পশ্চিম তীরে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। শুধু অক্টোবর মাসেই ৮৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ নাগরিক।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত টর ভেনেসল্যান্ড এক বিবৃতিতে বলেন,
“ইসরায়েলি বাহিনীর এই ধরনের প্রাণঘাতী অভিযান শুধু সহিংসতা বাড়াচ্ছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এটি নতুন করে প্রতিশোধের আগুন জ্বালাচ্ছে।”
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, ইসরায়েল পশ্চিম তীরে দমননীতি চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেনাদের পক্ষ নিয়ে বলেছেন,
“আমাদের বাহিনী নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছে। যারা ইসরায়েলি নাগরিকদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।”
পশ্চিম তীরে উত্তেজনা চরমে
এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পশ্চিম তীরের বিভিন্ন শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। রামাল্লাহ, নাবলুস ও হেবরনে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন ফিলিস্তিনিরা। তারা “ফ্রি প্যালেস্টাইন” স্লোগান দিয়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
রামাল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লায়লা হাম্মুদ বলেন,
“আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর মুখে বেঁচে আছি। ইসরায়েল আমাদের শিশুদেরও ছাড়ছে না। এই নৃশংসতার বিচার চাই।”
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা
ইসরায়েলি সেনাদের হাতে ফিলিস্তিনিদের হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৩ সাল ছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে রক্তাক্ত বছর। সেই সময় পশ্চিম তীরেই অন্তত ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশু ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান আরও বাড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাতের অন্ধকারে ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোতে অভিযান চলছে, যেখানে কোনো বিচার ছাড়াই মানুষ হত্যা করা হচ্ছে।
শিশু ও নারীও নিরাপদ নয়
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিম তীরের বিভিন্ন এলাকায় ৩৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৪৭ জন শিশু।
মানবাধিকার কর্মী নাসরিন হাম্মুদ বলেন,
“ইসরায়েল এখন কোনো বয়স বা পরিচয়ের পার্থক্য করছে না। যারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়, সবাই তাদের টার্গেট।”
গাজার সঙ্গে সমন্বিত সহিংসতা
বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিম তীরে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে গাজা যুদ্ধের ধারাবাহিক প্রভাব রয়েছে। ইসরায়েল এখন গাজা ও পশ্চিম তীর—দুই দিকেই আগ্রাসন চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের ভয় দেখানোর কৌশল নিয়েছে।
তবে এতে উল্টো প্রতিরোধ বাড়ছে। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস ও ইসলামিক জিহাদ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে,
“ইসরায়েল যতই হত্যা করুক, ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের মাটি ছেড়ে যাবে না।”
শান্তির আশায় বিশ্ব
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো পশ্চিম তীরে হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লিগসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলকে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. রাশিদ খালিদি বলেন,
“ইসরায়েলের এই নীতি দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিজেদের নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করছে। কারণ দমননীতি কখনো শান্তি বয়ে আনতে পারে না।”
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে দুই ফিলিস্তিনির এই হত্যাকাণ্ড কেবল একটি দিনের খবর নয়—এটি একটি চলমান মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। দখলদারিত্ব, অবিচার ও দমননীতির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রাম আজও অব্যাহত।
বিশ্ব যতদিন নীরব থাকবে, ততদিন রক্ত ঝরবে জেরুজালেম থেকে রামাল্লাহ পর্যন্ত।
শান্তির স্বপ্ন হয়তো এখনো দূরের, তবে সত্যের পথে ফিলিস্তিনিদের এই অদম্য লড়াই ইতিহাসে এক অবিনশ্বর প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে থাকবে।
MAH – 13665 I Signalbd.com



