বিশ্ব

আমেরিকা গত দুই দশকে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, হুতি প্রধান

Advertisement

ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী আনসারুল্লাহ হুতি আন্দোলনের প্রধান আব্দুল মালিক বদর উদ্দিন হুথি অভিযোগ করেছেন, গত দুই দশকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। তিনি দাবি করেন, এই যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো—বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ।

গত ৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) ইয়েমেনের রাজধানী সানায় আয়োজিত বার্ষিক ‘শহীদ স্মরণ সপ্তাহ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও ভাষণ দেন হুতি নেতা। তার এই বক্তব্য ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

হুতি নেতার অভিযোগ: “আমেরিকার যুদ্ধ মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে”

ভিডিও বার্তায় আব্দুল মালিক হুথি বলেন,

“আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের প্রেরণা নিয়ে যে জাতি এগিয়ে চলে, তারা কখনো পরাজিত হয় না। গত ২০ বছরে আমেরিকা ও তার মিত্ররা মুসলিম বিশ্বের ওপর এক ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। তারা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া থেকে শুরু করে ইয়েমেন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। অনুমান করা হচ্ছে, এই যুদ্ধগুলোয় প্রায় ৩০ লাখ প্রাণহানি ঘটেছে।”

তিনি আরও যোগ করেন,

“আমেরিকা ও ইসরাইল মুসলিম দেশগুলোকে দুর্বল করে দিতে চায়। তারা শুধু আমাদের সম্পদ লুট করেই ক্ষান্ত নয়, আমাদের চিন্তা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকেও ধ্বংস করতে চায়। তারা মুসলিম জাতিকে মগজধোলাই করে নিজেদের দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে।”

ইয়েমেন যুদ্ধের পটভূমি: ২০১৪ থেকে এক অবসানহীন রক্তপাত

ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধ শুরু হয় ২০১৪ সালে, যখন হুতি যোদ্ধারা রাজধানী সানা দখল করে নেয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট আবদরাব্বু মানসুর হাদিকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
পরবর্তীতে ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে সামরিক অভিযান শুরু করে হাদির সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। এই যুদ্ধেই হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারায় এবং দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটে পড়ে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী,

  • ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪ লাখের বেশি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নিহত হয়েছে।
  • প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ ইয়েমেনি নাগরিক বর্তমানে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
  • খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং জ্বালানির তীব্র সংকটে কোটি কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটেই হুতি নেতার বক্তব্য নতুন করে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়েছে।

“শত্রুরা ক্ষুধা ও অস্ত্র দিয়ে আত্মসমর্পণ করাতে চায়” — হুতি

আব্দুল মালিক হুথি বলেন,

“আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে আমাদের জনগণকে দুর্বল করে ফেলতে চায়। তারা মনে করে, ক্ষুধা ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমরা আত্মসমর্পণ করব। কিন্তু আমরা হুথিরা শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করি, তাই কোনো ভয় আমাদের দমাতে পারবে না।”

তার মতে, ইয়েমেনের যুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি “বিশ্বাস ও স্বাধীনতার লড়াই”। তিনি ইয়েমেনি জনগণকে “জিহাদের মনোভাব নিয়ে” ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ: কতটা প্রাণহানি ঘটেছে?

হুতি নেতার বক্তব্যের দাবিকে সমর্থন বা খণ্ডন করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে তথ্য বিশ্লেষণ করে আসছে।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্ট অফ ওয়ার’ (Cost of War) প্রজেক্ট–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধগুলোয় (যেমন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়া ইত্যাদি) প্রায় ৪৭ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই বেসামরিক।

এর মধ্যে:

  • আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে: প্রায় ৪৭ লাখের মধ্যে ৪ লাখের বেশি মৃত্যু
  • ইরাকে: ২ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি মৃত্যু
  • সিরিয়ায়: আমেরিকার বিমান হামলায় ও সংঘাতে প্রায় ১ লাখ বেসামরিক নিহত
  • ইয়েমেনে: সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বোমা হামলায় প্রায় ১ লাখ প্রাণহানি

যদিও এই সংখ্যা সরাসরি “আমেরিকার হাতে নিহত” নয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন জোট ও তাদের অস্ত্র সহায়তার কারণে এই যুদ্ধগুলোর প্রাণহানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়া ও ইরানের ভূমিকা

হুতি আন্দোলন মূলত ইরান-সমর্থিত একটি গোষ্ঠী। তেহরান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সামরিক সহায়তা অস্বীকার করলেও, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি—ইরান হুতি যোদ্ধাদের অস্ত্র, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে
এই কারণে ইয়েমেনের যুদ্ধ মূলত ইরান ও সৌদি আরবের পরোক্ষ সংঘাত হিসেবে দেখা হয়।

ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলো হুতি নেতার বক্তব্যকে “ন্যায়সংগত ও সত্যনিষ্ঠ” হিসেবে প্রচার করছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব এই বক্তব্যকে “প্রচার যুদ্ধের অংশ” বলে উল্লেখ করেছে।

বিশ্লেষণ: হুতি বক্তব্যের রাজনৈতিক বার্তা

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, হুতি নেতার এই বক্তব্যের সময় ও ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে ইয়েমেনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রায় অচল অবস্থায়। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি লোহিত সাগরে হুতি জাহাজ লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি বিমান হামলা চালিয়েছে। ফলে এই বক্তব্য জনগণকে উদ্দীপ্ত করে যুদ্ধের মনোবল ধরে রাখার কৌশল হতে পারে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ফারুক আল-হাশিমি বলেন,

“হুতি আন্দোলন এখন কূটনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়ে তারা মুসলিম বিশ্বের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করছে।”

মানবিক বিপর্যয়ের গভীর ছায়া

ইয়েমেনে বর্তমানে ৭৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। হাসপাতাল ও বিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গেছে, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন প্রায় বন্ধ।
জাতিসংঘ বলছে, “যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হলে ইয়েমেনে আগামী এক দশকের মধ্যে আরও দুই কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে।”

এই পরিস্থিতিতে হুতি নেতার বক্তব্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং একটি মানবিক আহ্বানও বটে—যেখানে তিনি ইয়েমেনের জনগণকে দৃঢ় মনোবল ও ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

যুদ্ধের দাম মানুষই দেয়

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের বাস্তব চিত্র হলো—
অগণিত প্রাণহানি, কোটি কোটি শরণার্থী, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর, আর ভেঙে পড়া মানবসভ্যতা।
হুতি নেতার দাবি যাই হোক না কেন, এই যুদ্ধগুলো যে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

বিশ্বজুড়ে এখন প্রশ্ন একটাই—“যুদ্ধের নামে মানবতা আর কতবার রক্তাক্ত হবে?”

MAH – 13659 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button