বিশ্ব

ফিলিস্তিনিরা কেন কান্না করতে পারে না বিশ্বব্যবস্থার নীরবতা

Advertisement

শার্ম আল‑শেখ ঘোষণার পরও গাজ্জায় চলেছে বোমাবর্ষণ; হাজারো শিশু ও অসহায় পরিবার ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরছে। আন্তর্জাতিক মহল নীরব—এই প্রতিবেদন বলছে কেন ফিলিস্তিনিদের কান্না বিশ্বকে নাড়া দিতে পারছে না।

গাজ্জা — রাতের অন্ধকারটা শান্ত নয়। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরও, শার্ম আল‑শেখ সভার রাজনৈতিক হাসিখুশির পেছনে গাজ্জায় মৃতদেহ, ক্ষুধা, ভয় এবং অপমান ঘোরাচ্ছে। যেখানে বিশ্বনেতারা শান্তি নিয়ে আলোচনা করছিলেন, সেখানে গাজ্জার নিরীহ মানুষ—বিশেষ করে নারী ও শিশু—রাতের নির্ঘুমতা ও অপমানের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাদের কান্না, তাদের ক্ষুধা, তাদের মৃত্যু—এই সবকিছু যেন বিশ্বব্যবস্থার চশমায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।

এই প্রতিবেদনে আমরা দেখব—কীভাবে শার্ম আল‑শেখের রোগমুক্ত বসার পেছনে গাজ্জার ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা মানবীয় কষ্ট মুছে যাচ্ছে; কেন আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ফিলিস্তিনিরা প্রত্যাশা করে ততটা সংবেদনশীল হচ্ছে না; এবং নির্দোষ শিশুদের জীবনের সম্মান ফিরিয়ে আনার কোন পথ আছে কি না।

যুদ্ধবিরতি, তবু হত্যাকাণ্ড চলছে

শার্ম আল‑শেখে যখন বিশ্বনেতারা মিলিত হয়ে যুদ্ধবিরতির পথ খুঁজছিলেন, তখন গাজ্জায় আঘাত থামেনি—বরং থেমে থেমে বোমাবর্ষণ চলেছে। যুদ্ধবিরতির ঠিক একদিন পরে নির্দিষ্ট কালে ইসরাইলি বাহিনী আরও একাধিক বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে; নিহতের সংখ্যা ছিল ১০৪ জনেরও বেশি—এদের মধ্যে ৪৬ জন শিশুও রয়েছে। একই পরিবারের ১৮ জন সদস্যও ওই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। শহীদদের অনেকের নাম আজও অজানা; তারা নীরবে ও বেনামে মৃত্যুবরণ করেছে।

এখানে প্রশ্ন উঠেছে—কীভাবে শান্তিচুক্তির নামে বসে থাকা রাজনৈতিক মহল এমন ঘটনার বিরুদ্ধে কঠোর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? কেন বিশ্বমঞ্চে হাসিমুখে করমর্দন হচ্ছে, কিন্তু একসঙ্গে গাজ্জার রক্তঝরা মাটিকে কেউ দেখতে বা বিচার করতে চাইছে না?

ব্যক্তিগত বেদনায় মানবতার অভাব

এক ফিলিস্তিনি বন্দির মেয়ে বলেছে, তাদের বাড়িতে সৈন্যরা ঢুকে হুমকি দেয়, তাদের আনন্দ উদযাপনের অধিকার নেই—এমনকি যিনি মুক্তি পেয়েছেন তার প্রতি সযত্নে থাকা ভালো সংবাদও উদযাপিত হয়নি। হাইসাম সালেম নামের এক বন্দি মুক্তি পাওয়ার পরে জানতে পারেন, তার স্ত্রী ও তিন সন্তান ইসরাইলি হামলায় শহীদ হয়ে গেছেন। হাসপাতালের কোল থেকে ফিরে তিনি করুণভাবে চিৎকার করেন—তার সন্তানের জন্মদিন বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, তাদের কিছুই বাকি নেই। তিনি নিজের মেয়ের জন্য ক্যার্টে তৈরির মত ছোট একটি ব্রেসলেট হাতে ধরেছিলেন—যেটি এখন আর কাউকে দেখাতে পারবেন না।

এই ছোট ছোট ব্যক্তিগত কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে বড় একটি সত্য—যখন এক জনগোষ্ঠীর মানুষের দুঃখ‑দুর্দশা সংবাদ মাধ্যমের চোখে লিপিবদ্ধ না হয়, তখন তাদের মানুষিক অস্তিত্বকেই হোল্ডিং করা হয়। ফিলিস্তিনিরা আজ প্রায়ই এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে, তাদের নিজস্ব অনুভূতি, স্মৃতি, বা ভবিষ্যৎ নেই—তাদের কাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান পায় না।

যে ‘মানবীয় ছবি’ দেখানো হয়, তা আংশিক ও পক্ষপাতদুষ্ট

ইসরাইলি গণমাধ্যম বদ্ধানে বন্দিদের জীবন নিয়ে বিস্তর বিবরণ দেয়—তাদের পছন্দের খাবার থেকে শুরু করে পরিবারের কাছে ফিরে আসার মুহূর্ত পর্যন্ত। টিভি-স্ক্রিনে একজন ইসরাইলি বন্দির ফিরে আসায় স্ত্রী ও ছেলের আবেগধর্মী দৃশ্য দেখানো হয়; দর্শকদের চোখেও জল দেখা যায়। কিন্তু একই সময়ে গাজ্জায় বড় সংখ্যক ফিলিস্তিনি শোকের্ত্তদের জন্য কোনো সমান প্রতিক্রিয়া নেই। এই দ্বৈত মানদণ্ড কৌতূহ্য জাগায়—কেন এক জনগোষ্ঠীর বেদনাকে বেশি মানবিকতা দেওয়া হয়, আর অন্যদের কষ্টকে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়?

এমন দ্বৈতচিন্তা শুধু মানবতাকে ক্ষুণ্ণ করে না, বরং সংঘটিত অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যখন মিডিয়া ও রাজনীতির ভাষা একদিকে দুর্বলকে মানসিক স্বীকৃতি দেয় না, তখন নির্দিষ্ট জনসমষ্টিকে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

সংখ্যাগুলো যা বোঝায়—মানবিক বিপর্যয়

যুদ্ধ ও অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত গাজ্জায় সঙ্কট কেবল মৃত্যু নয়; তা আরো বিস্তার লাভ করেছে—ক্ষুধা, তৃষ্ণা, চিকিৎসা সংকট, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহে বড় ব্যাঘাত। প্রকাশিত কিছু রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত; এবং শিশুদের সংখ্যা বিশাল—প্রায় ২০,০০০ শিশুসহ ৬৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। (উল্লেখ্য: এখানে করা সংখ্যা সুনির্দিষ্ট সরকারি হিসাব নয়—কতগুলি প্রাণহানির তথ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে।)

এই সংখ্যা কেবল পরিসংখ্যান নয়; প্রতিটি লাইন একটি পরিবার, একটি আঙুল, একটি মায়ের হৃদয়, একটি বাচ্চার হাসি—সব কিছুই হারায়। যখন বিশ্বব্যবস্থা এই সংখ্যা দেখে কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া না দেখায়, তখন প্রশ্ন ওঠে—মানবিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়েছে?

আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ও নীরবতা

শার্ম আল‑শেখে স্বাক্ষরকারী সরকারগুলো ফিলিস্তিনিদের পরামর্শ দিচ্ছে যে স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো আলোচনা—আহিংসা নয়; কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি দেখায় যে আলোচনা একতরফা হলে তাতে কার্যকারিতা আসে না। যে ইসরাইল কোনো দিনই চুক্তি মেনে চলবে না—এই আশংকা বহু অনুরাগীর কাছে বাস্তব। কথায় ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে আরেক জাতির জীবন-দৈনন্দিন নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে একদিকে কূটনৈতিক নিস্তব্ধতা, অন্যদিকে মাঠে চলমান রক্ত ঝরছে।

বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থ, সামরিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক জটিলতা অনেক সময় মানবিক বিবেচনাকে পশ্চাতে ঠেলে দেয়। ফলে গাজ্জার নিরীহ মানুষের কষ্ট আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘প্রাণবন্ত’ প্রতিক্রিয়া পায় না—এটি কেবল নীতিগত ব্যর্থতা নয়, মানবাধিকারের মৌলিক ক্ষতি।

সমাধানের খোঁজে—কী করা উচিত?

এই ধরনের একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি সংকটের জন্য একক সমাধান নেই; তবুও কয়েকটি স্পষ্ট পদক্ষেপ আছে যা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা গেলে মানবিক পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হতে পারে:

  1. তাত্ক্ষণিক মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া: খাদ্য, পানীয় জল, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। নির্দিষ্ট এলাকায় অবরোধ অবিলম্বে শিথিল করা উচিত যাতে সংকট কমে।
  2. স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান: সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও বেসামরিক লোকের ওপর হামলার অভিযোগগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত করা দরকার—আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালো, নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ন্যায়প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
  3. মিডিয়া এবং সমাজে ন্যায়সম্মত কাহিনী প্রচার: গণমাধ্যমকে দ্বৈতমান্য থেকে বিরত রেখে মানবিক কাহিনীগুলো সমানভাবে তুলে ধরতে হবে—ফিলিস্তিনিরাও মানুষের মতোই অনুভব করে বলে তা বিশ্ববাসীকে দেখাতে হবে।
  4. দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতি ও নিরাপত্তা সমাধান: শুধু সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়, স্থায়ী শান্তির জন্য আদর্শ কৌশল ও আলোচনা প্রয়োজন—যাতে দুই পক্ষই মানুষের অধিকার সুরক্ষিত দেখতে পায়। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান, দায়িত্বশীল মধ্যস্থতা ও স্থানীয় নেতৃত্বের আন্তরিকতা জরুরি।

কান্না শুনতে হলে শুনতে হবে মানবতা

ফিলিস্তিনিদের কান্না যদি বিশ্বকে নাড়া দিচ্ছে না, তাহলে সেই মুহূর্তে আমাদের অনিবার্যভাবে নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কি সত্যিই মানবতা রক্ষায় আগ্রহী? একটি শিশুর মৃত্যু শুধু একটি সংখ্যাই নয়; তা একটি জীবনের শেষের চিহ্ন এবং একটি পরিবারের অর্ধেক ইতিহাসের ধ্বংস। আন্তর্জাতিক কূটনীতি, শক্তি‑সম্বন্ধ এবং স্বার্থের পেছনে আশ্রয় নিয়ে মানবিক কষ্টকে অবহেলা করা ঠিক নয়।

আজকের পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের কষ্টকে দেখি—চোখে দেখবো, কণ্ঠে বলবো, কল্যাণের পথে কাজ করবো। গাজ্জার কণ্ঠ যদি আজ নিঃসঙ্গ হয়, আমাদেরকে চুপ থাকা যাবে না। কান্নাকে শুনতে হবে, বিচারকে জোরালো করতে হবে, এবং মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে—এগুলোই আজকের সময়ের ন্যায্য দাবি।

MAH – 13653 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button