উত্তর করদোফান রাজ্যের রাজধানী এল-ওবাইদে জানাজায় ড্রোন হামলা, শিশু ও নারীসহ অন্তত ৪০ জন নিহত
সুদানের উত্তর করদোফান রাজ্যের রাজধানী শহর এল-ওবাইদে এক মর্মান্তিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। শহরের একটি জানাজায় ড্রোন হামলায় অন্তত ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। হামলার পর পুরো এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা ওসিএইচএ (The Office for the Coordination of Humanitarian Affairs) জানিয়েছে, করদোফান অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
এল-ওবাইদে জানাজায় ভয়াবহ ড্রোন হামলা
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দুপুরে শহরের উপকণ্ঠে একটি গ্রামে জানাজা চলাকালীন হঠাৎ আকাশ থেকে ড্রোন হামলা চালানো হয়। মুহূর্তেই মৃত্যু ঘটে অন্তত ৪০ জনের, আহত হয়েছেন আরও অনেকেই।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, হামলাটি ছিল পরিকল্পিত। জানাজার তাঁবু লক্ষ্য করেই বোমা নিক্ষেপ করা হয়। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন রয়েছেন।
সুদানি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এই হামলার পেছনে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) জড়িত থাকতে পারে। যদিও আরএসএফ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
এল-ওবাইদ শহরটি বর্তমানে সরকারি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে শহরটির আশপাশের অনেক এলাকা আরএসএফের দখলে।
জাতিসংঘের তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ
জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “করদোফান অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। আমরা অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি এবং বেসামরিক নাগরিকদের জীবনরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে অনুরোধ করছি।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “সুদানের সংঘাত এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এল-ওবাইদে জানাজায় হামলা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান, তারা যেন সুদানে অবিলম্বে অস্ত্র প্রবেশ বন্ধ করে এবং মানবিক সহায়তার পথ খুলে দেয়।
আরএসএফ ও সেনাবাহিনীর সংঘাতে নতুন রক্তপাত
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সরকারি সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। এক সময় ওমর আল-বশিরের পতনে একসঙ্গে কাজ করলেও পরবর্তীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এই দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের সূচনা হয়।
এই সংঘাত ইতোমধ্যে দারফুর, করদোফান ও খার্তুমসহ বিভিন্ন প্রদেশে ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
গত সপ্তাহে আরএসএফ এল-ওবাইদ শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে বারা নামের একটি শহর দখল করে। এরপর হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তার খোঁজে এল-ওবাইদে পালিয়ে আসে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এখন এল-ওবাইদেও নিরাপদ নয় কেউ। হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই, রাস্তায় পড়ে আছে আহতদের আর্তনাদ।
মানবিক বিপর্যয়: লাখো মানুষ অনাহারে ও বাস্তুচ্যুত
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ করদোফান অঞ্চল থেকে ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
একই সঙ্গে জাতিসংঘ জানায়, বর্তমানে সুদানের দুই কোটিরও বেশি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে এবং ৩ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ চরম অনাহারের মুখে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) জানিয়েছে, দারফুর ও করদোফানের কিছু এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। শহরগুলো অবরুদ্ধ থাকায় খাদ্য, পানি ও ওষুধ পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দোহায় এক সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস ছাড়াও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বলেন, “এল-ফাশের ও করদোফানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ মানবতার জন্য কলঙ্ক। এই রক্তপাত এখনই বন্ধ করতে হবে।”
অন্যদিকে সুদানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াসিন ইব্রাহিম দেশবাসীকে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা শান্তি চাই, কিন্তু আত্মসমর্পণ নয়। আরএসএফকে প্রতিহত করতে জাতীয় প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে।”
সুদানি সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করেছে, তারা যেন আরএসএফকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করে।
ইতিহাস ও সংঘাতের পটভূমি
আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে অবস্থিত সুদান একসময় ছিল আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী দেশ। কিন্তু ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘূর্ণিতে পড়ে।
ওই সময় সেনাবাহিনী ও আরএসএফ মিলে বশিরের শাসন পতন ঘটায়, কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সেই দ্বন্দ্ব পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, যার ফলে আজ পর্যন্ত লাখো মানুষ নিহত বা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেশটি এখন কার্যত দুটি শক্তিশালী বাহিনীর লড়াইয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
আফ্রিকান বিষয়ক বিশ্লেষক মোহাম্মদ এল-আমিন বলেন, “এল-ওবাইদে জানাজায় হামলা প্রমাণ করে, সুদানে এখন কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। উভয় পক্ষই বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা করতে ব্যর্থ।”
তিনি আরও বলেন, “এই সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর কূটনৈতিক ভূমিকা নিতে হবে।”
অন্যদিকে এক জাতিসংঘ কর্মকর্তা বলেন, “এই হামলা কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।”
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্য পরিণতি
বিশ্লেষকদের মতে, করদোফান অঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে গৃহযুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে পার্শ্ববর্তী দারফুর ও নীল নদের প্রদেশে।
বর্তমানে রাজধানী খার্তুম থেকে দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল গৃহযুদ্ধের কবলে। সেখানে প্রশাসনিক কাঠামো প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
বিশ্ব সংস্থাগুলো বলছে, জরুরি সহায়তা ও শান্তি আলোচনার উদ্যোগ এখনই না নিলে এই সংঘাত আফ্রিকার অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটে রূপ নিতে পারে।
সুদানের করদোফান অঞ্চলে জানাজায় হামলা দেশটির চলমান গৃহযুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। মানবিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সহিংসতার এই দুষ্টচক্র থেকে সুদানকে মুক্ত করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগই হতে পারে একমাত্র পথ। প্রশ্ন এখন একটাই—এই রক্তপাতের শেষ কোথায়?
এম আর এম – ২০৯৯,Signalbd.com



