সুদানের পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের শহর আল-ফাশের সাম্প্রতিক ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাবের নির্বাহী পরিচালক ন্যাথানিয়েল রেমন্ড জানান, আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) শহরে গণকবর খুঁড়ে গণহত্যার প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করছে।
আরএসএফের দখল ও গণকবর খনন
২০২৫ সালের ২৬ অক্টোবর আরএসএফ উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশেরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এর আগে সুদানি সেনাবাহিনী (এসএএফ) শহরটি ছেড়ে চলে যায়। আরএসএফের নিয়ন্ত্রণের পরপরই শহরে গণহত্যা, গণ–উচ্ছেদ এবং সহিংসতার ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে।
ন্যাথানিয়েল রেমন্ড আল-জাজিরার কাছে জানান, “আরএসএফ শহর জুড়ে গণকবর খনন শুরু করেছে এবং সেখানে মরদেহ চাপাচ্ছে। তারা মূলত গণহত্যার প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।” ইয়েলের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্যাটেলাইট চিত্রে রক্তের দাগ, দেহ টেনে নেওয়ার চিহ্ন এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় ধ্বংসস্তূপ লক্ষ্য করা গেছে।
৭০ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আরএসএফের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর থেকে আল-ফাশের ও আশপাশের এলাকা থেকে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ নিরাপত্তাহীনতার কারণে পালিয়ে গেছে। মানবাধিকার সংস্থা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেখানে নাগরিকদের ওপর হত্যা, যৌন সহিংসতা এবং অন্যান্য গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
সুদানের আল-ফাশেরের স্থানীয় সাংবাদিক আবদাল্লাহ হুসেইন বলেন, “আরএসএফ পুরোপুরি দখল নেওয়ার আগেই শহরটি ১৮ মাস ধরে তাদের অবরোধে ছিল। কোনো ত্রাণ কার্যক্রম প্রবেশ করতে পারছিল না। হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ ছিল। এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে।”
মানবিক সংকট: খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জ্যাকুলিন উইলমা পারলেভলিয়েট জানিয়েছেন, “বর্তমান অস্থিতিশীলতা শহরে প্রবেশকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে আটকে পড়া মানুষদের কাছে খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা পৌঁছানো যাচ্ছে না।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, যারা শহরে রয়ে গেছে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাত্ক্ষণিক সহায়তা প্রয়োজন। অনেক ঘরে ঘরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ এবং শিশুরা এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আরএসএফ ও আন্তর্জাতিক নিন্দা
বিশ্বজুড়ে আরএসএফ এবং তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে নিন্দা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আল-ফাশেরের হত্যাযজ্ঞের দায় অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। আরএসএফের নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি হেমেদতি নামেও পরিচিত, ঘটনার তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু ইয়েলের রেমন্ড বলেন, “যদি তারা সত্যিই তদন্ত করতে চায়, তাহলে শহর থেকে সরতে হবে এবং জাতিসংঘ, রেডক্রস ও অন্যান্য মানবিক সংস্থার কর্মীদের প্রবেশ করতে দিতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে দেখা প্রয়োজন কে বেঁচে আছে এবং কারা নিহত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে আমরা আরএসএফকে তাদের কৃতকর্মের তদন্ত নিজেদের হাতে করতে দিতে পারি না। যেটা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, তা গত দুই বছরে গাজায় নিহতদের সংখ্যার চেয়েও বেশি হতে পারে।”
স্যাটেলাইট চিত্র ও হত্যার প্রমাণ
ইয়েলের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাবের ২৮ অক্টোবরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফ শহর দখলের পরপরই গণহত্যার প্রমাণ সনাক্ত করা গেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, শহরের বিভিন্ন স্থানে দেহ টেনে নেওয়ার চিহ্ন এবং রক্তের দাগ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থা মনে করছেন, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তৎপর হতে হবে।
সুদানের সংঘাতের পটভূমি
সুদানের দারফুর অঞ্চলে ২০০৩ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত চলছে। সরকারবিরোধী গোষ্ঠী এবং আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সংঘাত নতুনভাবে শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুদানি সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে টানা লড়াই চলছে।
দারফুরে যুদ্ধে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধরা বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বর্তমানে আল-ফাশের শহরে খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসার তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও তৎপরতা
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্রুত ত্রাণ এবং সহায়তা পাঠানোর জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতি কঠিন হওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা এবং গবেষকরা মনে করছেন, আরএসএফের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই আরও বড় মানবিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
জরুরি সহায়তার আহ্বান
ন্যাথানিয়েল রেমন্ড বলেন, “এখনই হাজার হাজার মানুষের কাছে খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা পৌঁছানো জরুরি। যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।”
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আল-ফাশেরের বর্তমান পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সমানভাবে চিন্তার বিষয়।
আল-ফাশের শহরে আরএসএফের দখলের পর ঘটে যাওয়া গণহত্যা, গণকবর খনন এবং মানবিক সংকট বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য সতর্কবার্তা। আন্তর্জাতিক নীতি, মানবাধিকার সংস্থা এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছে এবং আরএসএফের কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত শুরু হচ্ছে, ততক্ষণই আল-ফাশেরের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন।
MAH – 13628 I Signalbd.com



