বিশ্ব

নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হলেন জোহরান মামদানি

Advertisement

নিউইয়র্কের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়: জোহরান মামদানি শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলো বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী শহর নিউইয়র্ক। ৮৪ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার এই মহানগরীর নেতৃত্বে উঠে এসেছেন একজন তরুণ মুসলিম রাজনীতিক — জোহরান মামদানি। দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এই নেতা শুধু নিউইয়র্কেরই নয়, বরং পুরো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

কে এই জোহরান মামদানি?

জোহরান মামদানি ৩৪ বছর বয়সী একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, যিনি এর আগে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জন্ম আফ্রিকার উগান্ডায়, পরবর্তীতে ছোটবেলায় তিনি তার পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। তার পিতা আয়মান মামদানি একজন সমাজকর্মী এবং মাতা মীরা নাইর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি Monsoon Wedding এবং The Namesake এর মতো সিনেমার পরিচালক।

এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও মানবিক মূল্যবোধের পরিবেশেই বড় হয়েছেন জোহরান। পড়াশোনা করেছেন নিউইয়র্কের বোয়ারড কলেজে, যেখানে থেকেই তিনি সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।

নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়

২০২৫ সালের ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মামদানি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো, যিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত।

তবে নিউইয়র্কের ভোটাররা এবার ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন। তারা বেছে নেন তরুণ, উদ্যমী ও প্রগতিশীল এক নেতাকে — যিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা, বিশেষত জীবনযাত্রার ব্যয়, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমানোকে প্রধান ইস্যু করেছেন।

বুধবার (৫ নভেম্বর) আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ানদ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই নির্বাচনের ফল যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনাকেও বদলে দিতে পারে।

নিউইয়র্কের নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া

বহুজাতি ও বহুধর্মের এই শহরের বাসিন্দারা মামদানির বিজয়কে “অগ্রগতির প্রতীক” হিসেবে দেখছেন।
ব্রঙ্কস এলাকার সমাজকর্মী জোশুয়া উইলসন বলেন,

“ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকা ভীষণভাবে বিভক্ত। এমন সময়ে জোহরানের মতো তরুণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব আমাদের জন্য আশার আলো।”

৬৮ বছর বয়সী ভোটার লুসি কর্দেরো বলেন,

“আমরা পুরোনো নেতাদের দেখেছি। এখন সময় নতুন ভাবনার। মামদানি হয়তো সেই পরিবর্তন আনতে পারবেন।”

আরেক ভোটার, ব্রুকলিনের বাসিন্দা মেগান মার্কস বলেন,

“তার অবস্থান অনেকটা বামঘেঁষা হলেও দেশের বর্তমান বাস্তবতায় প্রগতিশীল নেতৃত্বই দরকার। মামদানি আমাদের ভবিষ্যতের প্রতীক।”

ধর্ম বা জাত নয়, নীতিই ছিল মূল ইস্যু

যদিও অনেকেই এই নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীর জয়কে ধর্মীয় সাফল্য হিসেবে দেখছেন, তবে মামদানি নিজে জোর দিয়েছেন একদম ভিন্ন বার্তায়।

বিজয় ঘোষণার সময় তিনি বলেন,

“আমি মুসলিম হিসেবে গর্বিত, তবে আজকের এই বিজয় কোনো ধর্মীয় নয়। এটি সেইসব মানুষের বিজয়, যারা প্রতিদিন বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছে — ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটাতে পারছে না, সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় নিয়ে চিন্তিত।”

তার এই বক্তব্যে প্রমাণিত হয়, তিনি ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সমতার রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিতে চান।

দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম ভোটারদের ভূমিকা

নিউইয়র্কের মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠী এই নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, আফগান, আরব — নানা ভাষা ও সংস্কৃতির এই জনগোষ্ঠী এক কণ্ঠে মামদানিকে সমর্থন দিয়েছে।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড্রাইভার ইফতেখার খান বলেন,

“২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর আমেরিকায় মুসলিমরা যেভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল, মামদানির বিজয় সেই অধ্যায়ের এক ইতিবাচক পালাবদল।”

নিউইয়র্কে প্রায় ৯ লাখ মুসলিম ভোটার রয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। এদের বড় একটি অংশ দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, যা মামদানির পক্ষে ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে।

প্রগতিশীল রাজনীতির নতুন চিত্র

মামদানি নিজেকে Democratic Socialist (গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী) বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, তার রাজনীতি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের রাজনীতি — যেখানে মুনাফার চেয়ে মানবিকতা অগ্রাধিকার পায়।

তার রাজনৈতিক দর্শনে প্রভাব ফেলেছে মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ (AOC)-এর চিন্তাধারা। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই দুই জনপ্রিয় প্রগতিশীল নেতা প্রকাশ্যে মামদানিকে সমর্থন করেন নির্বাচনের আগেই।

AOC বলেন,

“জোহরান মামদানি এমন এক নেতা, যিনি নিউইয়র্ককে কেবল উন্নত শহর নয়, আরও ন্যায়সঙ্গত সমাজ হিসেবে দেখতে চান।”

বিতর্ক ও প্রতিপক্ষের সমালোচনা

অ্যান্ড্রু কুয়োমো নির্বাচনের আগে অভিযোগ করেন যে, মামদানি “অভিজ্ঞতাহীন” এবং “চরমপন্থী”। কিন্তু ভোটাররা এই সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেন।
বরং অনেকের মতে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ্য সমর্থন কুয়োমোর জন্য উল্টো ফল বয়ে এনেছে।

৫৫ বছর বয়সী আইনজীবী অ্যালেক্স লরেন্স বলেন,

“আমি প্রথমে মামদানিকে ভোট দিইনি। কিন্তু পরে বুঝেছি, তার মধ্যে সততা আছে, আশাবাদ আছে। এটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”

বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া

জোহরান মামদানির জয় শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বজুড়েও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ব্রিটেনের The Guardian, ভারতের The Hindu এবং মধ্যপ্রাচ্যের Al Jazeera—সব মিডিয়াই এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রে “রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের জয়” হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। অনেকে লিখেছেন,

“জোহরান মামদানি দেখিয়ে দিলেন, কঠোর পরিশ্রম ও সততা থাকলে অভিবাসী সন্তানেরাও ইতিহাস গড়তে পারে।”

নতুন মেয়রের প্রথম প্রতিশ্রুতি

বিজয়ের পর নিউইয়র্কের প্যারামাউন্ট থিয়েটারে অনুষ্ঠিত সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ভাষণে মামদানি বলেন,

“আমরা এমন এক শহর গড়ব যেখানে কেউই ভাড়া দিতে না পারার ভয়ে ঘুম হারাবে না। আমাদের শহর হবে শ্রমজীবী মানুষের, শিক্ষার্থীদের, অভিবাসীদের, এবং তাদের সন্তানদের জন্য।”

তিনি ঘোষণা দেন যে, আগামী বছর থেকেই শহরের বাজেটে সাশ্রয়ী বাসস্থান, গণপরিবহন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড় বরাদ্দ রাখবেন।

ইতিহাসের সূচনা, ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা

জোহরান মামদানির জয় শুধু একজন প্রার্থীর বিজয় নয়, বরং একটি নতুন আমেরিকার প্রতিচ্ছবি — যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা জন্ম নয়, ন্যায় ও সমতার রাজনীতি অগ্রাধিকার পায়।

এই জয় প্রমাণ করেছে যে নিউইয়র্ক আজও বিশ্বের এক অন্যতম উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর, যেখানে বৈচিত্র্যই শক্তি।

জোহরান মামদানি আজ শুধু নিউইয়র্কের নয়, বরং পুরো বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণার নাম।

MAH – 13624 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button